স্বার্থহীনতার খোলস কার কত পুরু

আমাকে কিছু বলেনি সে। আমিও কিছু বলিনি। কাছে বসে দূরে বসার ভঙ্গিমায় বসেছিলাম শুধু। আর আপাদমস্তক দেখছিলাম তার কীর্ত্তিকলাপ। ও জানেনা আমি জানি তাকে। ও বুঝেনি আমি পড়ছিলাম তাকে। আমার পড়ার ভাষা তার কাছে দূর্বোধ্য জানি। তাই আমার ভাষাগুলো আমার কাছেই থাকে। আমি জানি তার পুরো জীবনই চলে যাবে শুধুমাত্র আমার আজকের এই নির্লিপ্ততাকে পড়তে। মনে হচ্ছে সারা জীবনেও করতে পারবেনা নির্লিপ্ততার কার্যকারণের ইতিবৃত্ত। এ আমার এক অনন্য অর্জন বলে আজ অনুধাবন করতে পারছি।

 
আমি জানি আমি কী! ও জানেনা আমি কি আদৌ পড়তে পেরেছি কী না! হতে পারে এ জীবনের অন্য কোন রহস্যের নাম। প্রকৃতি আসলে সবাইকে সবকিছু দেয়না। এ না দেয়া নিয়ে তার কোন অভিযোগ থাকতে পারেনা অথবা সে কোনদিনও বুঝতে পারবেনা প্রকৃতি কেমন করে তার সাথে ছেলেখেলায় মেতেছে। এ ক্ষেত্রে আমি প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতার একটা বার্তা পাঠাতে চাইছি খুব করে। হে প্রকৃতি, আমার কৃতজ্ঞতাটুকু গ্রহণ করো!
 
জীবন রচনার ইতিবৃত্তে কোন নারী থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু থাকে, কেমন করে যেন নিজেকে উপস্থিত করে ফেলে নারীরা। আমিও তার বাইরে ছিলাম না কোনদিনই। কিন্তু ইদানিং নিজেকে ভাঙবার কালে তাদেরকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলছি। আমার এ এড়িয়ে চলা মানে অবজ্ঞা নয়। নয় সামান্যতম হলেও কোনো অবমূল্যায়ন। কারণ জেনেছি সৃষ্টির সৃষ্টিই হয়েছে নারী থেকে। সৃষ্টিকর্তা নারী জাতির সৃষ্টিতে যতটুকু সময় নিয়েছেন তা অন্যক্ষেত্রে নিয়েছিলেন কী-না আমার জানা নেই। যেহেতু জানিনা তা আপাত জানবার ইচ্ছাও জাগছে না সামান্যতম হলেও। নারী মনে হয় সৃষ্টির এক অপূর্ব বিস্ময়! এ বিস্ময় বিস্ময়ের মাঝেই থাক, আমি চলি আমার পথে! হতে পারে এ এক আলগা কথা। তবে সাম্প্রতিক বাস্তবতার কিছু চিহ্ন আছে বৈকি! 
 
বলেছিলাম, মনোভঙ্গির কথা। এ মন নামক প্রপঞ্চ একেক জনের কাছে একেক রকমের হয়ে থাকে। কেউ কেউ স্বার্থপর আবার আবার কেউ কেউ স্বার্থপরতাকে মূখ্য বলে মনে করেনা। এই দুই প্রজাতির মধ্যে দ্বিতীয় পক্ষের অভাবের ব্যাপার খুব প্রকট। কোন মানুষই সামষ্টিক অর্থে স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিতে পারেনা। এই আমি যদিও নিজেকে স্বার্থহীন ভাবছি সেই আমি নিজে কতটুকু স্বার্থহীন তা নিয়ে আমার নিজের মাঝেও প্রশ্ন রয়েছে। আর যে স্বার্থপর বলে সমাজে বহুলভাবে প্রচারও হয়ে গেছে সে নিজে নিজেকে স্বার্থপর ভাবেনা কোন সময়েই। সে তার স্বার্থপরতাকে ভাবে অর্জন আর অধিকার বলে। এর কারণ আসলে কী হতে পারে? হতে পারে মনের বিচিত্র ভাবনার একেকটা প্রকাশ। হতে পারে মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজেকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় বলে পরিপার্শ্ব আর সমাজের গুরুত্বকে অনেক সময় গৌণ ব্যপার বলে মনে করে থাকে। তাই নিজের স্বার্থবাদিতা অন্যের কাছে যখন খুব দগদগে ক্ষতের মতো পরিগণিত হয় তখনো সে নিজেকে সবকিছু ছাপিয়ে এক অনন্য মানুষ বলে জাহির করতে চেষ্টা করে থাকে। হতে পারে এ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আবার এও হতে পারে মানুষের সমাজে বাস করা আরেক মানুষের জ্বলজ্বলে কুবৃত্তি!
 
মানুষের এই প্রবৃত্তি আর কুবৃত্তি নিজ এবং অন্যের কাছে একেক রকমের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে দেখেছি। কোন মানুষের আচরণ যেমন সার্বজনীন নয় তেমনিভাবে কেউই নিজেকে স্বার্থবাদীতার বিপরিতে দাড় করাতে পারেনা। যিনি নিজেকে স্বার্থহীন বলে প্রচার করতে চান তিনি আবার মনে মনে নিজের ঢোল বাজাতে চান। তিনি সময়াজের কাছে অপ্রত্যক্ষভাবে দাবি করেন সবাই তাকে স্বার্থহীন বলে প্রচার করুক। প্রচারের জন্যে তিনি আসলে স্বার্থহীনতার প্রচার করেন। এ স্বার্থ কুরে কুরে খায় সমাজকে। এ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ। নিজেকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার মাঝে যে স্বার্থপরতার বীজ লুক্কায়িত তা হয়তো সমাজের জন্যে নেতিবাচক কোন ফল বয়ে নিয়ে আনেনা কিন্তু মানুষের মন নামক প্রপঞ্চের কারণে অনেক সময়ে যে নিজেকে প্রচারের একটা গোপন অভিপ্সা লুক্কায়িত থাকে তা অস্বীকার করার জো নেই!
 
তবে মানছি কিছু মানুষের কাজের কারণে পৃথিবী নামক গ্রহের অনেক মানুষের উপকার সাধিত হয়েছে। তাদের অনেকেই স্বার্থপর ছিলেন না সাধারণ অর্থে কিন্তু সামগ্রিক অর্থে তাদের তাদের স্বার্থহীন বলতে আমি রাজি নই। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। আমি সে তর্কে নেই কিন্তু মনে হয় বিশ্বেস করতে খুব করে কষ্ট হবে তাদের স্বার্থহীনতার কথা। স্বার্থহীনতা মানে আত্মপ্রচার। এটা মনে হতে পারে নেতিবাচক অর্থ ব্যবহৃত কোন শব্দসমষ্টি তবে মনে হয় এখানে বাস্তবতার প্রতি কিছুটা হলেও নির্দেশক কিছু রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাদার তেরেসা, মানবতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র- মহীয়সি নারী। তার কাজের মাঝে কী স্বার্থপরতা ছিলো? তিনি কী ছিলেন পুরোটাই স্বার্থহীন? তার প্রতিষ্টিত মিশনারিজ অব চ্যারিটি কী ছিলো শতভাগ স্বার্থহীন কোন প্রতিষ্ঠান? উত্তর সাদা চোখে দুইশতভাগ স্বার্থহীন! কিন্তু এই স্বার্থহীনতার মাঝে কিছু আত্মপ্রচার ছিলো তা অস্বীকার করার উপায় নাই। আর এই আত্মপ্রচার মানে মিশনারিজের প্রচারই হলো তাদের স্বার্থ! এ থেকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো কিছু পাননি কিন্তু তার প্রতিষ্টিত মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রচার পেয়েছে, যেতে পেরেছে অনেকের খুব কাছাকাছি! এই স্বার্থ আসলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি সমাজের মাঝে বরং কিছু ইতিবাচক দিকের দৃষ্টি উন্মোচন করে দিয়েছে!
 
নিজের পেশাগত কারণে কিছু চ্যারিটি সংগঠন এবং সামাজিক বেসরকারি সংগঠনের সাথে যোগাযোগ অনেকদিনের। তাদের অর্থায়নের সবটুকুই হয় দেশের বাইরে থেকে। তার কিছুটার অর্থের ছাড়ের জন্যে সরকারের এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিতে হয়। কিছুটার কোন অনুমোদনের প্রয়োজন পড়েনা। কোন ফান্ড আসার পরে তাদের সে অর্থ ছাড়করনের তদবির খুব করে ভাবার উপলক্ষ্য এনে দেয়। কথা বলার টোন দিয়ে যে আকুতি আর তদবির প্রকাশ পায় সেখানে স্বার্থবাদিতাই মূখ্য; জনসেবা ত নয়ই! এ স্বার্থ আসলে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে হাসিল করার স্বার্থ। যা সমাজের জন্যে সামগ্রিক অর্থে খুবই বিপদজ্জ্বনক! এখানে যে কোন কাজের পরে যে প্রচার চালানো হয় তা নির্লজ্জ্ব আত্মপ্রচার ছাড়া আর কোন কিছুই নয়। কিছু সংগঠনের দায়িত্বশীলেরা যখন বলে তারা কোন অর্থের সংস্থান পাবার পরে দাতাদের ধন্যবাদ মেইল পাঠায় কারণ এ মেইল পাবার পরে তারা অনেক খুশি হয় এবং পরবর্তীতে সেই একইভাবে আবারো অর্থ পাঠায়। এভাবে পৌনঃপুনিক! এখানে ধন্যবাদ মেইল আবারো অর্থের নিশ্চয়তা প্রদান করে। যা সরাসরি স্বার্থসংশ্লিষ্ট! তাদের যে প্রচার-প্রচারণা তাও স্বার্থের বাইরে যেতে পারেনা। বাহ্যিকভাবে যতই স্বার্থহীনতার আবরণ দেয়া হোক না কেন এটা যে পুরোপুরি স্বার্থপরতার নিদর্শন তা বলার অপেক্ষা থাকে কী আর কোনো!
 
মসজিদের যে ঈমাম সাহেব হরদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ঈমামতি করছেন অথবা গ্রামাঞ্চলে কাউকে কাউকে জরুরী প্রয়োজনে তাবিজ অথবা ফুঁ দিচ্ছেন তিনিও কী স্বার্থবাদিতার বিপরিতে দাঁড়িয়ে যেতে পারছেন? মনে হয় না! কারণ মাস শেষে তিনিও সামান্য হলেও একটা মাসোহারা পাচ্ছেন। এমনিভাবে ফাদার, সিস্টার, পাদ্রী, ভিক্ষু, পুরোহিত সবার মাঝেই স্বার্থহীনতার আদল দিয়ে স্বার্থপরতা রয়েছে। তাদের মাসোহারা অথবা খাবার-দাবারের ব্যবস্থাটা তুলে দেয়া হোক দেখা যাবে কোন উপাসনালয়ে এমনভাবে বাহ্যিকভাবে নিবেদিতপ্রাণ মানুষের খোঁজ পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়বে! 
 
তাই কোন কোন সময়ে স্বার্থপরতাকে খুব বেশি আমলে নেয়ার দরকার বলে আমি মনে করিনা। কিন্তু স্বার্থহীনতার যে প্রকাশ্য ঘোষণা এবং প্রচার তাকে সমর্থন জানাতে খুব বেশি করে সময় নিতে ইচ্ছে করে। যে স্বার্থহীনতার পেছনে কিছু স্বার্থ ঘুর ঘুর করে তাকে খুব বেশি করে যাচাইয়ে সাধ জাগে! প্রশ্ন জাগে খুব বেশি করে হে স্বার্থহীনতার খোলসে গড়া মানুষজন, তোমার স্বার্থহীনতার খোলস কত পুরু!

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।