যুদ্ধাপরাধের বিচার: ফাঁকফোকর সব বন্ধ করতে হবে

 

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইব্যুনাল শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কি শেষ করতে পারবে? কারণ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের প্রশ্নে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন শুরু হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির একাংশ স্পষ্টতই এ বিচারের বিপক্ষে। এর বাইরে আর কেউই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করছে না। ব্যাপারটাকে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই।
 
বিএনপির একাংশ ও জামায়াতে ইসলামী একে রাজনৈতিক রঙ দিতে গিয়ে নিজেদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করছে বলে প্রতীয়মান হয়। বিএনপির একাংশের এমন ভূমিকায় বলতেই হয়; এটা দুর্ভ্যাগ্যজনক যে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া দল এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে নিজেদের অস্তিত্বের সাথে!
 
বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্যে গঠিত বিশেষ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। জামায়াতে ইসলামী একে বিরোধীদল দমনের কৌশল বলে দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রথমাবস্থায় বিএনপি এর বিপক্ষে কোনো  কথা না বললেও বর্তমানে তারাও এ বিচারের বিপক্ষে  মোটামুটি সরবই বলা যায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা থাকাবস্থায় এ বিচার করতে না পারলে এ বিচারের ভবিষ্যত যে হুমকির সম্মুখিন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
 
যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের এ বিচারকে  প্রলম্বিত করতে হেন কিছুরই বাদ রাখছেনা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বের  ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে  আসামিদের পক্ষে দাঁড় করানো  হচ্ছে প্রায় ১০/১৫ হাজার  সাক্ষী। বিষয়টি অদ্ভূত এবং  সেই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিতও  বটে। একজন আসামির পক্ষে আদালতে সাক্ষীর এমন বিশাল তালিকাতে আদালত  নিজেও বিব্রত হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা  দেয়া উচিত ছিল। যেহেতু দেশের  প্রচলিত আইনে সাক্ষীর সংখ্যা নিরূপন সম্পর্কিত কোনও আইন  কিংবা নির্দেশনা নাই,  সেহেতু বিচারাধীন আদালত  অথবা দেশের উচ্চ আদালত  এ বিষয়ের সুরাহা করতে পারে অথবা সরকার নিজেই আইন  প্রণয়ন করতে পারে। সাক্ষীর সংখ্যা নিরূপনের বিষয়ে সরকার  বর্তমানে কিছু বললে আসামিপক্ষ  বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি একে বিচারে হস্তক্ষেপ  বলে অপপ্রচার চালাবে সেই  হিসেবে বিচারিক আদালতের নির্দেশনা দেয়া উচিত। একইসঙ্গে এগিয়ে আসা উচিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকেও।
 
মানবতাবিরোধী  এ বিচারের বিপক্ষে দেশে-বিদেশে জোর প্রচারণা চলছে। জামায়াতে ইসলামী বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলে মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। তার কিছু নজির পাওয়া যায় ইন্টারনেটে একটু-আধটু ঘুরলেই। ইদানিং তারা উঠে পড়ে লেগেছে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ে। এর আগেও তারা বিচারের জন্যে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের জন্যে আবেদন জানিয়েছিল এবং সে সময়ে আদালত জানিয়েছিল বার কাউন্সিলই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। বার কাউন্সিল সে সময়ে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের আবেদনটি বাতিল করেছিল। কারণ বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল রুল-১৯৭২ এর ২৭ ধারায় আইনজীবী হিসাবে কোনো আদালতে মামলা লড়তে পাঁচটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম এবং অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো- সে ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। এর বাইরে সে ব্যক্তিকে বারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সনদ দেওয়ারও সুযোগ নেই। কিন্তু জামায়াতের আবেদন করা আইনজীবীদের এসব শর্ত পালনের সুযোগ নেই। 
 
জামায়াতের বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের  বর্তমান সম্ভাবনার কথা  জানা গেছে বার কাউন্সিলে  বিএনপি-জামায়াতপন্থী প্যানেল  জয়লাভের পর থেকেই। এটা  স্পষ্টতই তাদের কুটচাল। শুধুমাত্র  সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে  তাদের আইনভঙ্গের এখতিয়ার  থাকতে পারে না। বার কাউন্সিলে  তারা এমন অনাপত্তিপত্র পাস  করলে আদালতের একে গ্রহণ  করার খানিকটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা  এসে যায়, যদিও তাদের অনাপত্তিপত্রই  অবৈধ। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের  স্পষ্ট নির্দেশনা আসা উচিত খুব তাড়াতাড়িই। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আসার আগে বার কাউন্সিল এমন  অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত  নিয়ে নিলে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী এ বিচারকাজ ব্যাহত হবে  এবং সেই সাথে তৈরি হবে  দেশে-বিদেশে অপপ্রচারের আরও সুযোগ।
 
জামায়াতে  ইসলামীসহ বিএনপি এই বিচারকে  মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার  বলতে নারাজ শুধুমাত্র তাদের  রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আদালতের সবগুলোর শর্ত মেনে এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা International Criminal Court প্রতিষ্ঠা করে সেখানে গণহত্যার সংজ্ঞা প্রদান করে বলা হয়েছে: গণহত্যা বলতে কোনো জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মগোষ্ঠীর সার্বিক বা আংশিক ধ্বংসসাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত নিম্নধরনের কর্মকাণ্ডকে বোঝাবে;
 
ক) গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা  করা
খ) গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক অথবা মানসিক ক্ষতিসাধন
গ) সুপরিকল্পিতভাবে গোষ্ঠীর  জীবনে এমন অবস্থা তৈরি করা যা তাদের জীবনকাঠামোর  সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস  ডেকে আনবে (জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়। মানবতার  বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচার-প্রসঙ্গ- মফিদুল হক)।
 
যুদ্ধাপরাধের  বিচারের বিষয়টি প্রথম সংজ্ঞায়িত  হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর-- যখন গঠিত হয় নুরেমবার্গ ও  টোকিও ট্রাইব্যুনাল। এই দুই  বিচারসভার জন্য আন্তর্জাতিক  বিচারকমণ্ডলী যুদ্ধাপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেন মানবতার  বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে (বুলেটিন, আইন ও সালিস কেন্দ্র, ডিসেম্বর ২০০০)।
 
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বিচার ও আদালত নতুন কিছু নয়। ১৪৭৪ সালে হাগেনবাখের স্যার পিটারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। ১৮১৫ সালে পরাজিত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানকে অপরাধী ঘোষণা করে বৃটিশ সরকারের কাছে তুলে দেয় ভিয়েনা কংগ্রেস। পরে তাকে শাস্তিস্বরূপ সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়েছিলো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী জার্মানদের বিচারের দায়িত্ব জার্মান  সরকারের ওপর ন্যস্ত করে  মিত্র শক্তিসমূহ। ১৯২০ সালে ৪৫টি মামলার দায়িত্ব নিয়ে ১২ জনের বিচার করে জার্মানি এবং ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ-বিচার ‘লাইপজিগ ট্রায়াল’ নামে পরিচিত। যুদ্ধাপরাধীদের লঘুদণ্ড প্রদানের কারণে এ-রায় মেনে নেয়নি মিত্র শক্তি। মিত্র দেশগুলো নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৪৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল মিলিট্যারী ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। এটা নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত। জাপানের যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় টোকিও ট্রাইবুন্যাল।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের এখনও যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখান থেকে ধরে আদালতের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশে-দেশে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির অনেক নমুনা রয়েছে। হিটলারের সহযোগী আইখম্যানকে ১৯৬২ সালে আর্জেটিনা থেকে ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ১৯৯০ সালে বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোয় গণহত্যার জন্য মিলেসোভিচকে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এ দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাসে শুধু পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
সুতরাং  এ ধরণের বিচার বিশ্বের  ইতিহাসে নতুন কিছু নয়।  জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য  যে আমাদের দেশের মানুষের  বিপক্ষে অবস্থান নেয়াদের  স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের একাংশ যাদের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এটা অভাবিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে। জামায়াতে ইসলামী এ বিচারের বিপক্ষে দাঁড়াবে এটা অনুমিত কারণ তাদের রাজনীতি বিশেষত পাকিস্তানকেন্দ্রিক। এবং তাদের দলের উচ্চ পর্যায়ের সবাইই গণহত্যার সহযোগী ছিল।
 
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের  বিপক্ষে এবং এ বিচারের  দাবিতে দেশের সবাই একাট্টা  তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  বিএনপির একাংশ ও জামায়াতে ইসলামী যারা এ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা সংখ্যায় যে খুব বেশি তা বলা যাবে না। দেশের বেশিরভাগ মানুষই যেখানে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার দেখতে চায় সেখানে সরকারকে এ বিচারের পথকে নিষ্কণ্টক করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা নিতে হবে এবং তা এখনই! সামান্য একটু ভুল ও প্রলম্বিত পদক্ষেপ অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।
 
কবির য়াহমদ
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৮ ঘণ্টা, ২৮ জুলাই, ২০১২

 

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।