মঞ্চে এক মুক্তিসন্তান

 

খুব ছোটবেলা থেকে দেশের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটি আমাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিভাবে হয়েছিল তার আসল কারণ হলেন আমার বাবা। যিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি এবং আমাদের সাত ভাই-বোনেরা খুবই ভাগ্যবান যে আমরা এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। স্যালুট আমার বাবাকে।
 
আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে রাজনীতির সাথে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ভারতে যান এবং ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের করিমগঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাথে ছিলেন আমাদের গ্রামের আরো কয়েকজন। তারপর এক সময় দেশে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধে অংশ নেন। আমাদের গ্রামের আরো বেশ ক’জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ওহিদুজ্জ্বামান চৌধুরী ও বসারত আলী। দু’জনই প্রয়াত। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
 
গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরেও দুইজন রাজাকার ছিলেন। তাদের একজন নাসির উদ্দিন এবং আরেকজনের নাম খুব সম্ভবত খালিক মিঞা। তাদের দুইজনই খুবই তৎপর ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। গ্রামের কেউই নাকি সে সময়ে রেডিও শুনতে পারত না। রেডিওয়ের আওয়াজ শুনলেই তেড়েফুঁড়ে আসত। এমন হয়েছে একজন রাজাকার আপন চাচাত ভাইয়ের হাত থেকে রেডিও কেড়ে নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলার কাহিনীও আছে। এবং পাকিদের হাতে তুলে দিতেও চেয়েছে। অপরাধ একটাই রেডিও শুনেছে! তারপর মা-চাচীর অনুরোধে বেচারা সে সময়ে রক্ষা পেয়েছিলেন। আমার ছোট চাচাকে পাকিদের ক্যাম্পে ধরে নেয়া হয়েছিল অপরাধ একটাই তাঁর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা। অবশ্য আমার চাচা রক্ষা পেয়েছিলেন আরেক চাচা পুলিশে কাজ করেন এই তথ্য দেয়ার পরে। চাচা তখন করাচীতে ছিলেন। দেশে আসতে পারেননি। নাসির উদ্দিন এখনো বেঁচে আছেন। একটা হাবা-বোকা লোকের মত জীবন তার। তীব্র মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। অনেকেই বলে থাকেন গ্রামের মানুষের অভিশাপেই এমন হয়েছে তার। অন্যজন যিনি মারা গেছেন অনেক ধন সম্পদের মালিক ছিলেন। ছেলেরা জামাত-শিবিরের রাজনীতি করে। গ্রামের সাথে সে রকম যোগাযোগ নাই তাদের। অবশ্য গ্রামের কেউই তাদের গুরুত্ব দেয়না। অপরাধ একটাই একাত্তরের রাজাকারের সন্তান।
 
আমার দাদীকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি টেনশনে এতখানি থাকতেন যে অনেকেরই মুখে শুনেছি তিনি নাকি বেশিরভাগ সময়েই আমাদের বাড়ির পাশের মসজিদে দোয়া-দরুদ পড়তে বসে থাকতেন। তাঁর একটাই চিন্তা আর ভাবনায় ছিলেন আমার বাবা। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের মাঝে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে হযরত শাহজালালের (রহঃ) ৩৬০ জন সহচরের একজন সহচর হযরত জিন্দাপীর এর মাজার আমাদের মসজিদের সাথেই। তাই দাদীর সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করা। এটা আসলে দেশপ্রেম, সন্তানপ্রেম আর টেনশনের একটা জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
 
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশে যখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এলো। তখন আমার বাবা আজিজ উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন প্রার্থী। আরেকজন প্রার্থী ছিলেন আজিজ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। দু’জনেরই প্রায় একই নাম। দু’জনই মুক্তিযোদ্ধা। ভাল বন্ধুও বটে। সমমনাদের মাঝে বৈঠক হল এবং সিদ্ধান্ত হল আমার বাবা যেহেতু বয়সে ছোট তিনি হবেন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং অন্যজন হবেন চেয়ারম্যান প্রার্থী। নির্বাচন হল এবং দু’জনই নির্বাচনে জিতে গেলেন। সেই থেকে আমার বাবার নাম অনেকটা ঢাকা পড়ে যেতে লাগল ভাইস চেয়ারম্যান নামের আড়ালে। এমন হয়েছে আশপাশের অনেকেই মূল নাম এর সাথে ভাইস চেয়ারম্যান নাম জুড়ে না দিলে খুব সমস্যায় পড়ে যেত। এটা আমি নিজেও দেখেছি। এটা ছিল মধুর এক সমস্যা। একটি স্বাধীন দেশ নিয়ে আসার যুদ্ধের পরে দেশ গঠনে তাঁর এ ভূমিকা ছিল অনন্য। এবং মানুষজনের এ ভালোবাসায় আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।
 
এমন হয়েছে আমাদের ভাই অথবা কাজিনদের অনেক দূরের কোথাও এলাকার নাম জিজ্ঞেস করার পরে জানতে চাইতো ভাইস চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির পাশে কী আমাদের বাড়ি? এটা এক অনন্য অর্জন। একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম আর দেশ গড়ার কাজের স্বীকৃতি বলে মনে করি। স্বভাতই স্যালুট মুক্তিযোদ্ধা এই সূর্যসন্তানের প্রতি।
 
আমার বাবার কাছে আমরা চিরঋণী যে তিনি শুধুমাত্র একটা বাংলাদেশের জন্যে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেই থেমে থাকেননি। তাঁর সন্তানদের দেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই দেশপ্রেমের ব্যাপারটা নিজেদের মাঝে থেকে অনুভব করে থাকি একেবারে ভেতর থেকে। আমার মা একইভাবে শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের। তাই আর সব কিছু থেকে দেশ আমাদের কাছে আরাধ্য এক। দেশের প্রতি ভালোবাসা অসীম।
 
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন কমেনি। যে শরীরে একজন মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বয়ে চলে তাঁর জন্যে এ ভীষণ কষ্টের। তবু এ কষ্টের পরেও আশায় বুক বেঁধে থাকি স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন একদিন থামবেই থামবে। আমরা যারা দেশকে অন্তরে ধারণ করি তারা যদি সবাই এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের যাবতীয় ব্যর্থতার পরেও সফলতার হাসি হাসবই। এর কারণ একটাই হতে পারেঃ
 
মঞ্চে এক মুক্তিসন্তান
এটা একটা কবিতা, উৎকৃষ্ট কবিতা
ভাবতে পারো আত্মপ্রচার, হয়তো তা-ই
আমার বাবা এক মুক্তিযোদ্ধা,গণযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা
সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে পেড়ে এনেছিলেন এক দেশ;বাংলাদেশ।
 
বাংলাদেশ,তোমার জন্ম যে পথ বেয়ে
সে পথের কোনো এক মাসে এসেছি আমিও
যদিও তুমি আমা থেকে বছর কয়েক বড়
তবু আমিও দেখিনি তোমা থেকে খুব একটা কম
হয়ত তোমার মতো নয় অভিজ্ঞ কোনও এক
ভাবতে পারো পোড় খাওয়াজন,খাঁটি সো্না!
 
এই ফাল্গুণ গত হয়েছিল গত বছরে
তা লিখে রাখেনি কোনো সংবিধান
ছাপা হয়নি কোনো খবরের কাগজে
কোনো টক-শো তে বসেনি কোনো টিভি চ্যানেল
তবে আমি লিখে রেখেছিলাম বলে ফের অবগাহন করি
আর একটা জ্বলজ্বলে সুর্যে রাখি তুমুল পদক্ষেপ
তো্মাকে সামনে রেখে।
 
এ আমি গর্ব করতেই পারি আমার পিতাকে নিয়ে
গর্ব করতে পারে আমার পিতামহ,তাঁর পিতা আর পিতামহ
আমার পরিজন,আত্নীয়-অনাত্নীয়
একটা সূর্য সন্তানের দেখা পেয়েছে বলে।
দিন যায়,মাস যায়,আসে আর একটা দিন–মাস
ঘটনা যা-ই ঘটে যাক এই ফেব্রুয়ারিতে
যতই পিলখানা ঝড়ে ঈশ্বরকে কাঠগড়ায় আনে বিশ্বলো্ক
আমি এই চৈত্রে এসে ঘোষণা দিয়েছি শ্রেষ্ঠত্বের
কারণটাও জানে সবে—
মঞ্চে দাড়িয়ে গেছে এক সূর্যসন্তান।

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।