ধর্মের খোলসে ধর্মান্ধতার বীজ: তবু আমরা আশাবাদী হবো!

 

ধর্মের খোলসে ধর্মান্ধতার বীজ: তবু আমরা আশাবাদী হবো!

কবির য়াহমদ

 

আমরা কি চিরকাল পড়েই থাকবো পথের ধারে? আমাদের মাঝে কী কখনোই হবেনা ইস্পিত পরিবর্তন সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে? এ প্রশ্ন নিরন্তর! তবু আশায় আলো জ্বলে রেখেছে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যাদের মাঝে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মানসহ সহাবস্থান। এটা আমাদের আশাবাদী করে। আমাদের আশাবাদ বৃথা যাবে তা হলফ করে বলতে পারবে না কেউই!

সে অনেক আগে থেকে এখানে ধর্মের খোলসে ধর্মান্ধতা নিয়ে মেতে আছে অনেকেই। অনেকে ধর্ম আর ধর্মান্ধতাকে একই সুতায় গেঁথে নিচ্ছে। অথচ ধর্মের সাথে জনমানুষ ও সামাজিকতার কোন বিরোধ নাই ও ছিল না কোনকালেই। যুগে যুগে এই ভূ-ভূমে বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক তাদের ধর্ম প্রচার করে গেছেন সম্প্রীতির বাণী শুনিয়ে। তাদের কেউই ধর্মকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা-অপচেষ্টা করে যাননি। শাহজালাল, শাহপরান, বায়েযিদ বোস্তামী তাদের সবার মনেই সব ধর্মের প্রতি সমান স্থান ছিল। তারা তাদের ধর্ম প্রচারের জন্যে বিভিন্ন উপায়ে মানুষের কাছাকাছি গেছেন এবং সফল হয়েছেন। সময়ের সাথে তাদের লৌকিক অন্তর্ধান সূচিত হয়েছে কিন্তু তারা এখনো থেকে গেছেন মানুষের অন্তরে। গড়ে উঠেছে মাজারসহ স্মৃতি সংরক্ষণাগার। এখানে যেমন দলবেঁধে মুসলমানেরা আসে ঠিক তেমনিভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীরাই আসে। জনমানুষের এ ঢেউ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন কোন একক ধর্মকে যেমন আলোড়িত করা উচিত নয় ঠিক তেমনিভাবে প্রকাশ করে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবেই। যদি একান্তই কোন বিশেষ ধর্মকে নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকতেন তবে এখানে সব ধর্ম ও মতের মানুষের এমন মিলনমেলা ঘটতো না। অপরদিকে উনিশ শতকে যখন এ ভূখণ্ডে ধর্মসংস্কারমূলক ব্রাক্ষ আন্দোলন শুরু হয় তখন তারাও ধর্মকে জোর করে চাপিয়ে দেননি। জানা যায়, ব্রাক্ষ আন্দোলন না যা গড়ে উথেছিল তা মুসলমান ও খ্রিষ্ট্র ধর্ম থেকে বহুবিধ আচার উপাদান সংগ্রহ করেছিল। হিন্দু ধর্মের রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ ভারতবর্ষে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে একটা সত্যাসত্য মিলিত রূপই চেয়েছিলেন।

এ গেলো আগেকার সময়ের কাহিনী। ফাও মনে হতে পারে কিন্তু এ ইতিহাস টেনে আনার পেছনের কারণ হলো হঠাত করেই আমাদের এখানে ধর্ম নিয়ে বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো কেন? কেনই বা মানুষকে ধর্মকে ব্যবহার করতে শিখে নিলো কেন? এর উত্তর পরিস্কার সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে যখন রাজনীতিকে ধর্মের অবাধ ব্যবহার শুরু হয়েছে তখনই রাজনীতিবিদেরা নিজেদের প্রয়োজনে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোন না কোন বিশেষ ধর্মকে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন এবং অপব্যবহার করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। ফলে একটা সময়ে এ অপব্যবহার সাধারণ ব্যবহার হিসেবে পরিগণিত হয়েছে শুধুমাত্র মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করেই। কারণ ধর্ম বিষয়টি যেখানে সবচেয়ে সেনসিটিভ সেখানে এর যথোপযুক্ত ব্যবহার প্রকৃত অর্থে অপব্যবহার করেই মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছে। এই বিভেদে কোন ধর্ম প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে লাভবান হয়নি উল্টো এক ধর্মের মানুষের কাছে অন্য ধর্মের মানুষকে ক্লীব হিসেবে রূপায়িত করেছে। সৃষ্টি করেছে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস। যা বিশ্বাসের ভিত্তিমুলকে ক্রমে দূর্বল থেকে দূর্বলতর করে দিচ্ছে।

এই অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার বীজ বপন শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই। শুধুমাত্র ধর্মকে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার  নীতি গ্রহণের মাধ্যমেই। ধর্মভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে পাকাপোক্ত করতে যেয়ে রাজনীতিবিদেরা ধর্মের নামে ধর্মান্ধতাকে প্রাকটিস করেছেন। ফলে মানুষের আবেগের স্থান ধর্মকে ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত রাখার জন্যে। সংস্কার এবং কুসংস্কার যেমন একই কথা না ঠিক তেমনিভাবে তারা ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মান্ধতার চাষ করেছেন অবলীলায়। ফলে যারা সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ সরল কথায় তারা লাভবান হলেও ধর্মের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে গেছে অপব্যবহারের মাধ্যমে।

এর আগে থেকে ধর্মের নামে রাজনীতির যাত্রা সূচিত হলেও ১৯৪৮ সালের মার্চে গভর্ণর জেনারেল হিসেবে ঢাকা আসলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan. তখনই আসলে প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসে তার। অথচ এই জিন্নাহই ১১ আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্থানের নবগঠিত ব্যবস্থাপক সভার ভাষণে বলেছিলেন, “সময়ের সাথে সাথে দূর হবে সংখ্যালঘিষ্ট গোষ্ঠীর সাথে সংখ্যাগরিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যকার, হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যকার পার্থক্য”। এখানে তিনি গোষ্ঠী বা কমিউনিটি বলে আলাদা করে দিয়েছিলেন সব। তিনি বলেননি হিন্দু ও মুসলিম জাতির কথা! এর মাধ্যমেই তার সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ পায় যা অনেকেরই চোখ সে সময়ে এড়িয়ে গেছে প্রবলভাবে।

জিন্নাহ প্রথমে সাম্প্রাদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছিলেন তার মত করে। পরবর্তিতে পাকিস্থান রাষ্ট্র একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে পড়ে সময়ের সাথে সাথে। এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সংগঠনের পেছনে অন্যান্য অনেক কারণের সাথে ছিল অসাম্প্রদায়িক একটা জাতি রাষ্ট্র গঠনের। যা এর আগে শুধুমাত্র তুরস্ক ছাড়া আর কোন মুসলিম দেশ করতে পারেনি।

১৯২৮ সালে তুরস্ক সেক্যুলারিজমের ধারণা নিয়ে গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সে সেক্যুলারিজমের ধারণা নিয়ে এগিয়েছিল। যদিও এই সেক্যুলারিজমের ধারণাকে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষ আবার কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে নিজ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করেন কিন্তু আদতে এটা যে অসাম্প্রাদায়িক একটা ধারণার সমষ্টি তা ধারণা করা হয়। কিন্তু পচাত্তরের পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে এই অসাম্প্রাদায়িক ধারণাকে টুঁটি চেপে ধরা হয়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ সংযুক্ত করেন এবং পরবর্তীতে এরশাদ সরকার রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্থান দেন। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ সংযোজন এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার ফলে ধর্ম হিসেবে ইসলামের কী কোন লাভ হয়েছে? হয়নি। উল্টো দেশের বিশেষত অসুমলিম সম্প্রদায়ের কাছে ইসলাম ধর্মকে অপ্রত্যক্ষভাবে একটি প্রতিপক্ষ ধর্ম হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। এখানে ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন হাত ছিল না। যা করার করে নিয়েছে রাজনীতিবিদেরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীনেরাই তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। অপ্রকাশ্য উষ্মা বিরাজ করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ ধর্ম হিসেবে ইসলাম আবির্ভূত হয়েছে ইসলামের ধর্মের কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই রাজনীতিবিদদের কারণেই।

এই পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি ও গোষ্টি সৃষ্টি করার পাশাপাশি এই সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদেরাই আবার একে রক্ষার মিশন নিয়ে মেতে উঠেছে। সংবিধান সংশোধন করার নাম উঠলেই ধর্ম গেল বলে চিৎকার করে। যে বা যারা এই সংশোধনের কথা বলে তাদেরকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে বসে। তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে যখন বাংলাদেশ সেক্যুলারিজমের ধারণাতে ছিল তখন কী দেশে ইসলাম ধর্ম ছিল না? তখন কেউ কী ইসলাম পালন করতে পারনি? এখানে তাদের নিরুত্তাপ জবাব ধর্মের নামে ধর্মান্ধতার বাতায়নকে নির্দেশ করে।

ধর্ম ও ধর্মান্ধতার এই বিষবাষ্প শুরু হয়েছিল পাকিস্থান থেকে এবং এর ষোলকলা পুর্ণ করেছে আরব দেশগুলো। সেখানে যখন থেকে তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে তখন থেকেই তারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মান্ধতাকে উস্কে দিয়েছে। তাই জাতিতে জাতিতে সংঘাত তাদের কাছে হয়ে পড়ে ছেলেখেলা। ধর্মের নামে মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে ধর্মান্ধতার চাষ করে গেছে সব সময়েই। তাই যখন বাংলাদেশে পাকিস্থানে শাসকশ্রেণী নির্বিচারে মানুষ মেরেছে তখনো আরব দেশগুলো ছিল নির্বিকার। উল্টো অনেকেই তাদের সমর্থন দিয়ে গেছে পূর্বাপর। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সাদর অভ্যর্থনা পায় লিবিয়ায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মান্নান রাষ্ট্রীয় সমাদর পেয়েছে সাদ্দামের হোসেনের ইরাকে। আর খুনি গোলাম আযমের জন্যে সর্বদা উদারহস্ত সৌদি আরব! এখানেও তারা ধর্মের নাম নিয়ে লালন করছে অধর্ম উস্কে দিচ্ছে ধর্মান্ধতা স্বদেশে-বিদেশে। অথচ ইসলামে কোনভাবেই হত্যাকারীকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার কোন বিধান কোনকালেই ছিল না আর এখনো নাই কারণ মুহাম্মদ (সাঃ)এর অন্তর্ধানের পর ইসলাম ধর্মে আর কোন রীতি-নীতি সংযোজন ও বিয়োজনের সুযোগ নাই।

ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা, রগ কাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় ধর্মবিরোধী কাজের সূচনা হয়ে আসছে আমাদের দেশেও। যারা এসবের সাথে জড়িয়ে আছে তারা ধর্মান্ধতার খোলসে আবদ্ধ অনেক আগে থেকেই। মানুষের ধর্মের প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে অধর্মের চাষ করে যাচ্ছে নিয়ত। যেখানে ধর্মের কোন যোগ নেই সেখানে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন নামে আবির্ভাব হয়ে চলেছে। প্রকৃত ধার্মিকের কোন সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই এই অধর্ম পালন ও ধর্মান্ধতাকে লালন হচ্ছে দিন দিন। মার খাচ্ছে ধর্মের ইস্পিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এক ধর্মের সাথে অপ্রত্যক্ষ বিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকেই। এর মূলে রয়েছে দুষ্ট রাজনৈতিক চর্চা ও সাধারণ জনমানুষের আবেগের অতিপ্রকাশ অথবা অপ্রকাশ।

ধর্মে ধর্মে বিরোধ সৃষ্টি ও ধর্মান্ধকে উস্কে দেয়ার কাজ যারা করছে তারা কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য- উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এগিয়ে চলছে। অপরপক্ষে যারা সুশীল তারা প্রকৃত কারণ বের করার চাইতে শুধুমাত্র পারস্পরিক তীর নিক্ষেপের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে পারস্পরিক সম্পররোন্নয়নের পরিবর্তে শক্রু মানসিকতার পারদ তীব্র হয়ে চলছে দিন দিন। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে কারণ ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেনি আগেও এবং এখনো করতে চায়না। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি এই ধ্যাণ-ধারণাকে লালন করলে এবং এই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিকে তাকালেই কেবল আমরা অনুধাবণ করতে পারব এই ভূখণ্ডে  ধর্মে ধর্মে নিবিড় সহাবস্থান ছিল, ছিল না ধর্মের নামে অধর্ম আর ধমান্ধতার চাষ।

আমাদের অন্তর্চোখ বলে দেয় আশাবাদী হও- কোন একদিন এখানেও ধর্মাবন্ধতার শেকড় সমূলে উৎপাটিত হবে; হবেই! 

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।