কমবয়েসী যুবা, আলোকচিত্রি এবং মিথিলা

 

বাগানে ফুল ফুটেছে। বাগানে ফুল ফুটবে সেই স্বাভাবিক, এখানে বলাবলির কী আছে? ফুল ফুটবে, গন্ধ ছড়াবে, মৌমাছি আসবে, প্রজাপতি আসবে! আরে দূর! মৌমাছি আসবে কেন? ওখানে কী মধুর চাক আছে যে মৌমাছিকে আসতে হবে! তা নয় হয় নেই কিন্তু ভেবে নিয়ে সমস্যা কোথায়! পথচলতি পথিক হঠাত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। অতিউৎসাহী পথিক যার ঘাড়ে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে মাতিয়ে চলে পাড়া পাড়া সে অবাক হয়ে ফুলের কাছে গিয়ে জানিয়ে দেয় নিজের উপস্থিতি ক্লিক ক্লিক ক্লিকানোর মাধ্যমে! তারপর মুচকি হেসে দেখে নেয় নিজস্ব আবিস্কার প্রথমে সংকুচিত অবয়বে তারপর একসময় জুম করে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। মনে মনে ভাবে নাহ, হলো না এবার! তারপর আবারো ক্যামেরা তাক করে ফুলের উপর। নিজেকে বাকা-ত্যাড়া করে কখনো দ আকৃতি নিয়ে ঝুলে পড়ে অন্য কোন নীরিহ গাছের উপরে। আশপাশকার গাছগুলো অতি নিরীহ তারা হা-না কিছুই করতে পারেনা মানুষস্বরে। তারা মুখ বুজে সহ্য করে নিজস্ব রীতিতে নিজের প্রতিবাদ জানিয়ে চলে কিন্তু ক্যামেরাম্যান অথবা আলোকচিত্রির কান সে শব্দ অথবা প্রতিবাদ ধারণ করতে পারেনা ফিবার। তাই আবারো ক্লিক, ক্লিক! আরেকটা ছবি! এবার আলোকচিত্রি খানিকটা সন্তুষ্ট হলে ক্যামেরা দিকে তাকায় আর অফুটস্বরে বলে- শাহ্‌! আলোকচিত্রির সন্তষ্টচিত্তের প্রকাশের সাথে সাথে নিরীহ গাছগুলো নিজের অবস্থানে চলে আসে। আলোকচিত্রির কাষ্টমুখের আনন্দ হাসির সাথে সাথে পথ ধরে আবারো নতুন কিছুর দিকে আর পেছন ফিরে আবারো ফুলের দিকে তাকিয়ে যায় আড়চোখে; কে জানে হয়তো এখানেও অনূদিত হয় নূতন কোন চিত্রকল্পের পাঠ!
 
এ আলোকচিত্রি একটা চরিত্র হয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। নিজেকে সে স্থান দিতে চায় অন্য কোন এক উচ্চতায় যেখানে সে কোনদিনও পৌছাতে পারেনি কিংবা এমনও হতে পারে তাঁর অগ্রজদের কেউই যায়নি সেই সে চূড়ায়। তবু তাঁর নিয়ত সাধনা ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্তই। কে জানে ঘুমের ঘোরেও সে সেখানে যেতে চায় কীনা!
 
এ আলোকচিত্রিরও একটা জীবন আছে বলে জানা গেছে। তার সে জীবনে খানিকটা কাহিনীও ছিলো। এ কাহিনীর কোন দৃশ্যে শেষ কবে তাদের পরস্পরের কথা হয়েছে তা মনে পড়েনা। হয়তো খুব বেশিদিন হয়নি অথবা অনেক দিন হয়ে গেছে বলে সময়ের হিসেব রাখা হয়ে উঠেনি। ব্যাপারটা আসলে অদ্ভুতই ঠেকে মাঝে মাঝে। অদ্ভুত মানে ভূতের আছর করা নইলে এ শব্দের মাঝে ভূতের উপস্থিতি থাকবে কেন আর কেনই বা এ শব্দ নিয়ে এতো বেশি আশ্চর্যরকমের কাহিনীকর্ম। হতে পারে ভূতের উপস্থিতি আছে বলেই অদ্ভুত শব্দটা সত্যিকার অর্থেই অদ্ভুত!
 
গল্পের প্রয়োজনে একটা চরিত্রের নাম দেয়া হবে। নাম দিয়ে গিয়ে অনেক অনেক নামের ভীড়ে একটা মানানসই নাম খুঁজে নেয়া কষ্টকর। এ নাম দেয়া মানে একটা মানুষ চরিত্রের অবয়ব দেয়া। মাধ্যমিক স্তরের পাঠিগণিতের মতো মনে করি গল্পের চরিত্রের নাম মিথিলা। মিথিলা, বাহ বেশ সুন্দর নাম ত! এ নামে গল্পটি চলবে ভালো। নামের কারণেই কমবয়েসী পাঠকেরা এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। কমবয়েসীদের প্রতি সবারই লোভ! সবাইই এদেরকে নিজেদের দলে ভিড়াতে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকে সব সময়ই। কমবয়েসীদের স্বপ্ন পসরা নিয়ে বসে থাকে। তাদের হরেক রকম স্বপ্নের ভীড়ে মিথিলা একটা বিশাল স্থান যে দখল করে নেবে তা নিয়ে মনে হয় খানিকটা নিশ্চিতই থাকা যায়! স্বপ্নের মাঝপথে এ কমেবয়েসীরা মাঝে মাঝে আতকে উঠবে রোমান্সের গন্ধ পেয়ে। ভাববে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড ঘুমের ঘুরে থাকতে পারলেই হতো। অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যেতো মাঝরাতে খুব একাকী সময়ে। মিথিলাকে খুব কাছ থেকে দেখা হত! কিন্তু তা হবার নয়। পাঠকেরা মিথিলাকে পেয়ে গেলে গল্পের কী হবে। ঐ একরাতেই গল্পের কাহিনী শেষ হয়ে যেতো। কমবয়েসীদের হাতে সারাদিনের ভাবনা উপলক্ষ্যে তবে হাতছাড়া হয়ে যেতো। ইস আর উফ এই ধ্ববীযুগল মনের মাঝে দিনমান বাজবে বলে আড়ালের কেউ এই অনতিতরুণদের ঘুম ভাঙিয়ে দেন নিয়ম করেই! এছাড়াও এখানে আলোকচিত্রির প্রতি খানিকটা সহানুভূতির ব্যাপার ত আছেই!
 
ধরে নেয়া যাক, মিথিলা খুব একটা সুন্দরী নয়। তাঁর দেহ সৌষ্ঠব খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তাকে অবশ্য নাদুস-নুদুস বানানো যাবেনা। এতে করে অনতি তরুণ পাঠকেরা ক্ষেপে যেতে পারে। তাদের ক্ষ্যাপানো যাবেনা। কারণ তারা এ গল্পের প্রাণভোমরা। তারা দিনমান স্বপ্ন দেখবে। তারা সারাদিন থাকবে রাতের অপেক্ষায়। মিথিলা তাদের সাথে দেখা করতে আসবে স্বপ্নের মাঝে। বিগত রাতে যেখানে স্বপ্নের শেষ হয়েছিলো তাঁর কয়েক মিনিট আগ থেকেই তাদের স্বপ্ন শুরু করতে চাইবে। তাদের হিসেবের বিগত রাতের স্বপ্ন শুরু হবে আগের দিনের শুরুর কয়েক মিনিট আগ থেকে এর শেষের ব্যাপ্তি আগেকার রাতের কয়েক মিনিট পর- এমনই তাদের প্ল্যান! হাজারো তরুণ, হাজারো স্বপ্ন, লক্ষাধিক ভাবনা। তারা পাঠক অথবা স্বপ্নপিয়াসী স্বপ্নপথিক। তারা স্বপ্ন দেখে বুকের বা’দিকে চিন চিন করে ব্যথা জেগে উঠে। এ ব্যথার ব্যাপ্তি বাড়ে পেটে-তলপেটে!
 
কমবয়েসীদের অনেক স্বপ্ন মিথিলাকে নিয়ে। তারা দিনমান স্বপ্ন দেখে রাতেও দেখে নবরূপে নতুন কিছু আবিস্কারের নেশায়। তারা নিজেদের নিয়ত সাজায় নিজস্বরূপে। দিন দিন প্রতিদিন কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারেনি আজ আবধি। তারা রোজ রোজ ব্যর্থ হয় কাছে পেতে কিন্তু ব্যর্থতায় উদ্দম হারায় না। তাদের এ উদ্দম আচানক। হতে পারে পারে কমবয়েসী আকাঙ্ক্ষা জড়ানো যেখানে থাকতে পারে লোভনীয় কিছুর আচানক রঙ।
 
আর সবার মতো কোন একদিন আলোকচিত্রিও প্রেমে পড়ে মিথিলার। আলোকচিত্রির বয়েস খুব বেশি না হলেও কমবয়েসীদের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। আলোকচিত্রি নিজেও জানেও পঁচিশে ছেলেদের ম্যাচুরিটি আসে। সে সময়ে খুব বেশি লোক পাওয়া যায়না যারা মাত্র প্রেমে পড়ে থাকে। কিন্তু আলোকচিত্রির এছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। মনে হতে পারে আলোকচিত্রি তবে জোরপূর্বক পড়ে গেছে মিথিলার প্রেমে। এ জোর করা ব্যাপার আসেনি মিথিলার পক্ষ থেকে অথবা অপরাপর কোন পক্ষের কাছ থেকে। আলোকচিত্রি নিজের অজান্তেই মিথিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো তারপর এ ব্যস্ততা আকর্ষনে রূপ নিলে তার করার ছিলো না কিছুই। আসলেই কি কিছুই ছিলো না করার- এও প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার বলে আড়ালে অনেকেই প্রশ্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু উত্তরদাতা এখানে নিজের অবস্থান খানিকটা ধোঁয়াটে রাখতে চান বলে এর উত্তর আসলে পাওয়া খুব কষ্টকর বৈকি!
 
আলোকচিত্রির সাথে মিথিলার ঘনিষ্টতা প্রকৃত অর্থে ছবির সূত্র ধরে। ক্যামেরার লেন্সে আঁকা মিথিলা বাস্তবের চাইতে অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে আলোকচিত্রির মন পড়ে যায় তার অবয়বে। ফুল-পাখির সাথে মিথিলা অন্য অর্থে ধরা দেয় আলোকচিত্রির কাছে। তাই দিনভর কাজের শেষে মাঝরাতের কোন একান্ত সময়ে নিয়ম করে মিথিলার দেহ সৌষ্ঠবে আলতো করে হাত দেয় আলোকচিত্রি। তখন অন্য এক মানবীয় আর মাধূর্যময় রূপ নিয়ে হাজির হলে বেচারা আলোকচিত্রির পঁচিশের যুবামন নিজের পৌরুষকে বিসর্জন দিতে পারেনা! হামলে পড়ে নিজস্বতায় যৌবনের গতি নিয়ে প্রতি রাতে নিয়ম করে। তারপর কোন একদিন কমবয়েসী যুবাদের মতো মাঝরাতে স্বপ্নের মাঝে আবিস্কার করে মিথিলাকে। অবিবাহিত পুরুষের মানসিক আর শারিরীক আকাঙ্ক্ষাকে মাঝরাতে স্বপ্নের মাঝে আলোকচিত্রি আবিস্কার করে নয়ারূপে যা সে জাগরণকালে ভাবেনি কখনো অন্তত মিথিলাকে নিয়ে। তাই কমবয়েসী যুবাদের মতো আতকে উঠে মাঝরাতে; মিথিলাকে স্বপ্নের মাঝে পেয়ে। স্বপ্ন এগোয় ক্রমশ। মিথিলা কাছে আসে, পাশে বসে। হাত বাড়িয়ে দেয় আলোকচিত্রির হাতের দিকে। আলোকচিত্রির নীলাভ চোখগুলো লোভাতুর হয়ে উঠে। মিথিলা হাত রাখে আলোকচিত্রির বাম হাতে। মাঘের শীতের মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে আলোকচিত্রির হাত। নিজেকে ভাবতে বসে সে সত্তরোর্ধ পুরুষ। মিথিলা মুচকি হাসে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে ফিরে পাবার প্রানান্ত চেষ্ঠায় মেতে উঠে আলোকচিত্রি। মিথিলার ধরা বাম হাতে ঠক ঠক কাঁপন থামাতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চাপে। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে আলোকচিত্রি নিজের বাম হাতে নিজের ডান হাত এগিয়ে দেয় কাঁপন আটকাবে বলে। ক্রমে নিজেকে ফিরে পায় আলোকচিত্রি। একপ্রস্থ হাসি বিনিময় পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মিথিলার হাত ধরতে যায় সে তাড়াহুড়ো করে। ঠিক সে সময়েই ঘুম ভেঙ্গে যায় কমবয়েসী যুবাদের মতো। বিছানায় তড়পড়িয়ে উঠে। মনোজগৎ আর শারিরীক খানিক পরিবর্তনে অবাক হয় সে। এই বয়সে এমন কেন হয় ভাবতে গিয়ে ভাবে সে ত আর অনতিতরুণ নয় যে রাতে রাতে নয়া নয়া স্বপ্ন দেখে নিজের শারিরীক পরিবর্তন আর চাহিদাকে জানান দেবে। পরক্ষণে ভাবে সেও ত অবিবাহিত যুবা!
 
সেই শুরু। তারপর আলোকচিত্রি নিজেকে মনোনিবেশ করে দিনের কাজে দিন হয়ে এলে। দিনকার মতো সেও ফুল-পাখির পিছু ছোটে। ফুলের দিকে ক্যামেরা তাক করলে মাঝে মাঝে মিথিলা আসে। আকাশে উড়া পাখির দিকে তাক করলে মিথিলা আসে। সে আগ্রহ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলে। মনের মাধুরীর পুরোটাই ঢেলে দেয় ওখানে। একসময়ে ক্যামেরার সংকুচিত ক্ষুদ্র স্ক্রিনে মিথিলাকে দেখতে গিয়ে অবাকই হয়- সে আসলে মিথিলাকে তুলে আনতে পারেনি। মিথিলার বদলে হাজির হয়েছে রোজকার মতো ফুল-পাখি আর অপরাপর সব। যা নিয়ে আগেও তুলেছিলো অনেক অনেক ছবি। যার মাধ্যমে কোন একদিন সে সরকারী কোন এক অনুষ্ঠানে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারের হাত থেকে নিয়েছিলো সম্মাননা আর পুরষ্কার। আলোকচিত্রি অবাক হলেও এ যাত্রায় হতাশ হয়না।
 
আলোকচিত্রি বুঝতে পারে মিথিলাতে মগ্ন হয়ে গেছে সে। তাই কোন এক সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বাহানায় তার কাছে গিয়ে ভিড়ে। মিথিলাও হতাশ করেনা তাকে। কাছাকাছি থেকে কাছে আসা। আলোকচিত্রি স্বপ্নে দেখা কাহিনীর অনুবাদ করতে চায় বাস্তবে। স্বপ্নে যা পারেনি তার ষোলকলা পূর্ণ করতে চায় বাস্তবে এসে। আচমকা শারীরিক পরিবর্তনকে আমলে নিয়ে মিথিলাকে বলে ঘুম ভাঙার পরের সময়ের কাহিনী। প্রথম দিন মিথিলা রাগ করে চলে গেলেও পরের দিন একইভাবে নতুন মশলা জোগান দিয়ে কাহিনী বলে নিলে মিথিলা আকর্ষিত হয়। সে শুনে যায় সব। খানিক লজ্জ্বায় লাল হয় মুখাবয়ব। আলোকচিত্রি বুঝে মিথিলার চোখের ভাষা। সে বুঝতে পারে এপর্যায়ে এসে কিছুটা হলেও নিজের দিকে আকর্ষিত করতে পেরেছে। মিথিলা খানিক অবাক হবার ভঙ্গিমা দেখালে মনে মনে সেও এ নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। ভেতর থেকে কে জানি তার মনোজগতে নাড়া দিয়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে তার দেহের কোষে কোষে। কিন্তু তা সে এ যাত্রায় প্রকাশ করে না নারীত্বের দোহাইয়ের কারণে। এ দোহাইয়ের প্রকাশ সে শেখেনি কারো কাছ থেকে কিন্তু আপনা থেকেই প্রকৃতি তাকেও শিখিয়ে দিয়েছে আপনা ভঙ্গিমায়।
 
আলোকচিত্রি আঁচ করতে পারে মিথিলার মনোজগতের পরিবর্তন। তাই সে বারে বারে একই কাহিনীর কথা বলে যায়। মিথিলাও শুনে। কিন্তু বাস্তব জগতে আসতে ভয় পায় সে। সামাজিকতা এখানে সামনে এসে দাড়ায়। তাছাড়া আগামীর খন্ডিত ভাবনা। আলোকচিত্রি জীবনের ছলাকলার কথা বলে উপভোগের কথা বলে। মরে গেলেই সব শেষ। মিথিলাও মাথা নাড়ে। মুচকি হাসি ফোটে আলকচিত্রির ঠোঁটের কোণে।
 
ছবির প্রয়োজনে কয়েকবার আলোকচিত্রির বাসায় এসেছে মিথিলা। একা একা আসা বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই। আলোকচিত্রি নিজস্ব পটে তুলেছে তার ছবি; ঘরে-বাইরে!মিথিলা আলোকচিত্রির চিত্রশিল্প হতে পেরে খুশী আর আলোকচিত্রিও খুশি চিত্রকল্প আঁকতে পেরেছে বলে।আলোকচিত্রি মিথিলাকে নিয়ে অনেক দূর এগোতে চায়। ঠিক তেমনিভাবে মিথিলাও চায় এগিয়ে যেতে।
 
আলোকচিত্রির খুব ইচ্ছা একদিন শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে সাতার কাটবে মিথিলাকে সাথে করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলে মিথিলা না করতে পারেনা। কিন্তু বিপত্তির জায়গাতে দেখা যায় শহরের পাশ দিয়ে যে নদী বয়ে চলে গেছে সেখানে সাতার কাটার উপযোগি কোন পানিই নেই। পানি নাম নিয়ে যা আছে তা আসলে আবর্জনার স্তুপীকৃত অংশ। তাই তাদের আপাত পরিকল্পনা বাদ পড়ে যায় আপনা থেকেই। তারা অন্য পথে এগোয়। ভাবে দূরে কোথাও গিয়ে নিজেদের হারিয়ে নেবে অজানার উদ্দেশে। এমন করে তাদের ভাবনাগুলো পাখা মেলে আপনা থেকে। দিন দিন নতুন নতুন করে ভাবে আর ভেবে যায়। পরিকল্পনাগুলো পরিকল্পনাবিহীন হয়ে উঠলে বাস্তবায়নের পথে নেমে আসে অসাঢ়তা!স্বপ্ন দেখার সময়ে স্বপ্ন দেখে চলে। গোসল করা হয়ে উঠেনা কোন নদীতে একসাথে! উড়া হয়না বাস্তবে দূর আকাশে শুধু শুধু ভাবনার পসরারাজি ছাড়া।
 
মিথিলা একদিন বায়না ধরে রেললাইন ধরে হেঁটে যাবে মাইলের পর মাইল। এ জীবনে সে কখনো রেল চড়েনি শুনে অবাক হয় আলোকচিত্রি। রেল চড়ার মজার অভিজ্ঞতা বলতে যায় সে। মিথিলা শুনে আর অবাক হয়ে বলে রেল লাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে কয়েক মাইল হেঁটে গেলে তার রেল চড়ার শখ পূর্ণ হয়ে যাবে। রেলের গতি এত ধীর কেন এমন ছেলেমানুষি প্রশ্নের জবাবে আলোকচিত্রি বলে জীবনের সাথে রেলের মিল অনেকখানি। জীবন যেমন ধীর লয়ে এগিয়ে চলে গন্তব্যের দিকে রেলও তেমন ক্রমে ধেয়ে চলে মাইলের পর মাইল হয়ে তার গন্তব্যে। জীবন যেমন কোন একদিন নিয়ম করে নিশ্চিতভাবেই তার শেষ ঠিকানায় পৌছায় রেলও তেমন করে নিশ্চিতভাবেই গন্তব্য বিন্দুতে গিয়ে থামে। আলোকচিত্রির উত্তরের ধরণ আর আত্মবিশ্বাসে মিথিলা অবাক হয়।
 
আলোকচিত্রির বাসার পাশ দিয়ে একটা রেললাইন সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে অনেক অনেক দূর। আলোকচিত্রি নিশ্চিত করে জানেনা কোথায় গেছে তার গন্তব্য কিন্তু এ পথে তার হাঁটা হয়েছে অনেক দিন। কখনো ছবি তোলার জন্যে আবার কখনো বা কিছুদিনের পরিচিত কারো সাথে সঙ্গ দেবার জন্যে। এ পরিচিত জনদের মাঝে কয়েকজন মেয়েও ছিলো কিন্তু সে পরিচয় ছিলো পরিচয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ। পরিচয় থেকে এর ব্যাপ্তি বেশিদূর এগিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কে পৌছায়নি তা। এই প্রথম কোন মেয়েকে নিয়ে এমন করে রেললাইন ধরে হাটছে সে। যার সাথে তার সম্পর্ক আত্মিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে অন্যমাত্রা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। তাই রেললাইনের সরু স্লিপার খা খা রোদে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে গেলেও এ তপ্ততার মাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে আসা খানিক মৃদুমন্দ হাওয়া। আলোকচিত্রি এ তপ্ত রোদে মিথিলার হাত ধরতে চায়। মিথিলা না করেনা। সেও আগ্রহ নিয়ে বাড়িয়ে দেয় তার হাত। বাদামী রঙের আলোকচিত্রির হাতের মাঝে আশ্রয় নেয় হলুদ রঙা মিথিলার হাত। আশপাশজনের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে কী যাচ্ছেনা এ নিয়ে আলোকচিত্রি মোটেও মাথা ঘামায়না। সে হলুদ রঙা একটি হাত নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে চলে রেললাইনের স্লিপার ধরে।
 
আলোকচিত্রি অবাক হয় চৈত্রের খা খা রোদ্দূরে হাপিয়ে উঠা মিথিলার মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ না পড়ায়। সে বুঝতে পারে এ আসলে ভালোবাসাময় খেলা। ভালোবাসার কারণেই এমন হয়ে যায় সব। তাই আবারো কোন একদিন আমন্ত্রণ জানায় সে এমন করে কোন অভিযানে নেমে যেতে। মিথিলাও হাসূচক মাথা নাড়ে। আলোকচিত্রি সন্তুষ্ট চিত্তে দেখিয়ে দেয় আকাশ ভেঙ্গে আজ রোদ নেমেছে রেললাইনের ওপরে। সাথে থাকা বালুময় মাটি চিক চিক করে শুঁষে নিয়ে রেখেছে সুর্যের সমূহ আলো। তাই ওপর থেকে যতটা না গরমে অতিষ্ট হয় আর বাকি সব ক্লান্ত পথিক তাদের ক্লান্তির পালে আরো জোরে হাওয়া লাগায় নিচের মাটি। অন্য সবার চোখে মিথিলা-আলোকচিত্রি হয়ে যায় পথিককুলের কোন একজন। কিন্তু তাদের বিশ্বাসে তারা থেকে যায় আর অনেক কিছু। রেললাইন তাদের আর সব থেকে আলাদা করে রেখেছে একসাথে নিজেদের নিয়ে এসেছে বলে।
 
পাখিদের বাদানুবাদের মতো কোন একদিন আলোকচিত্রি আর মিথিলার মাঝে খানিকটা বাদানুবাদ হয়ে এলে পাখিসমাজের মতো তারাও একদিন নীড় ছাড়া হয়। আলোকচিত্রি নিজস্বতায় ফুল-পাখিতে ব্যস্ত সময় কাটাতে চাইলে মিথিলা চলে আসে নিজস্ব পৃথবীতে। আলোকচিত্রি আর ইদানিংকার কয়েকদিন মাঝরাতে স্বপ্ন দেখেনা। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে না তার। ইতস্তত হয়ে নিজের বিসর্জনের দিকে অবাক হয় না সে খুব একটা। বয়সের কারণে কিংবা অতিব্যবহার কে জানে তবে তার মাথার মাঝে কেবলই বাড়ে ফুল-পাখি আর গাছের সমারোহ। তাই মিথিলা থেকে আপাত দূরে চলে যায় নিজের অজান্তেই।
 
একাকী সময়ে একদিন মিথিলা আসতে চায় আলোকচিত্রির কাছে চিত্রশিল্প হবে বলে। আলোকচিত্রি ফিরিয়ে দেয় সময় নেই অজুহাতে। মিথিলার অবাক চোখ নিজেকে সংবরণ করে হাঁটা ধরে পা পথের দিকে। আলোকচিত্রি নিজেকে মনোনিবেশ করে মূর্ত চিত্রশিল্পে। ফুল-পাখি আর গাছেদের কাছে তার অনেক কিছু পাবার আছে বলে নিজে নিজেকে প্রবোধ দেয়।
 
রাত হয়। দিন নামে। আলোকচিত্রির ব্যস্ততা বাড়ে। নির্ঘুম রাত সখা হয়ে আসে তার। মাঝে মাঝে ঘুমাতে যায় ভোর করে। মাঝে মাঝে ভোর হয়ে আসে মাঝরাতেই। চিত্র আর চিত্রশিল্পে মজে যায় সে আজন্ম বোবাদের মতো! ভুলে যাওয়া স্বপ্ন একদিন ফিবার উঁকি দেয় মাঝরাতে। একটি হলুদ রঙা হাত ধরে ফেলে তার বাম হাত। ঠক ঠক করে কেঁপে উঠে পুরো আত্মা। নিজেকে সামলাতে গিয়ে পারেনা সে। ধড়ফরিয়ে উঠে ঘুম থেকে। গলা শুকায় অসময়ে।
 
কমবয়েসী যুবাদের মতোই আলোকচিত্রি নিজেকে আবিস্কার করে আবারো সেই আগেকার মতোই!

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।