একাল এবং সেকালে আমাদের ঈদঃ ত্যাগ হোক মূলমন্ত্র

 

প্রতিবারের মতো আবারো ঈদ আমাদের দরোজায় কড়া নাড়ছে। আর দিন দুয়েক পরেই ঈদ। ঈদুল আযহা যা সাধারণ ভাষায় আমরা কোরবানীর ঈদ বলে থাকি। কোরবানী মানে ত্যাগ। এই বলা ভাষার অর্থ উদ্ধারে বুঝাই যায় এ ঈদের সাথে ত্যাগ জড়িয়ে আছে। 
 
ছোটকালে ঈদ মানে ছিলো আনন্দের প্রতিশব্দ। বছরের শুরু থেকেই ঈদের জন্যে ছিলো সতত প্রতীক্ষা। তারপর সময়ে সময়ে ঈদের দিনক্ষণ গণনা শুরু। তারপর একটা সময়ে খুব কাছাকাছি চলে আসতো তখন উত্তেজনার পারদ দীর্ঘ হতে থাকে। আহ,আহা সে দিন!
 
ঈদ মানে সেমাই-পায়েশ এমন একটা কথা জোর প্রচলন ছিলো আগে থেকেই এবং এখনো আছে। কিন্তু আমাদের তখন খাওয়া-দাওয়ার চাইতে বেশি টানতো নতুন কাপড়। নতুনা কাপড়ের গন্ধ আর সৌন্দর্যে অবাক চোখ তাড়া করতো মুহুর্তের পর মুহুর্ত। হাতে পেয়ে কত কাছে নিয়ে আসা যায় তার অব্যক্ত প্রতিযোগিতা চলতো নিজেদের মাঝে। এমন ব্যাপার কখনোই কারো কাছে প্রকাশ হতো না ঠিকই কিন্তু নিজে থেকেই নিজের মাঝেই ছিলো সে প্রতিযোগিতা। এ এমন এক প্রতিযোগিতা যেখানে আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী ছিলো না ঠিকই। তবে মনে হতো কত আরাধ্য ধন নিজের কাছে চলে আসে ঘোষনা দিয়ে হলেও অঘোষিতভাবেই।
 
যখন ছোট ছিলাম দৈহিক অবয়বে তখন বড়দের মতোই নিজের ঈদের জামা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। কার থেকে কার বেশি আসবে তা নিয়ে চলতো সমানে সমান লড়াই। কখনো কম পাইনি কারো থেকে কিন্তু নিজেদের ভাই-বোনদের সাথে কথার লড়াই হতো। যেখানে অবশ্য সবাইই জয়ী হতো। কিন্তু কার জামার চাইতে কারটা বেশি সুন্দর তা নিয়ে কথার লড়াইয়ে মাঝে মাঝে মা-বাবাদের প্রবোধ শুনতাম একেকটা একেক রকম সুন্দর। এতে করে আমরা হয়তো খানিক কথার লড়াই থামাতাম কিন্তু মনে মনে ভাবতাম আসলে বাবা-মা আমার সে সময়ের প্রতিপক্ষ ভাই অথবা বোনকে থামাতে বলতেন একেকটা একেক সুন্দর আসলে এখানে প্রকারান্তরে বাবা-মা বলে দিয়েছেন- আমারটাই বেশি সুন্দর!
 
সে ছিলো অনন্য সুন্দর কিছু দিন আর সময়। ঈদের দুই দিন আগে জামা-কাপড় নিয়ে আসার আগে রীতিমতো উত্তেজনা কাজ করতো; সত্যি সত্যি আমারটা কেমন হয়! মাঝে মাঝে এমন হতো ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে জামা নিয়ে আসা হয়ে গেছে। স্কুলের বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে সাথে সাথে বলতাম জামা ঘরে আছে। অথবা এমনও ছিলো কেউ জিজ্ঞেস না করলেও বলতাম জামা কিনে আনা হয়ে গেছে। এবং কী কী এলো আর কী কী আসবো তাঁর ফিরিস্তি। তখনো খেয়ালেই থাকতো না কে শুনতে চায় আর কে বা শুনে বিরক্ত হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া দেখার। মনে হতো এইতো সুযোগ নিজেকে আর নিজের প্রাপ্তি সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দিতে। কেউ দেখতে চাইলে দেখাতাম না মোটেও- ঈদের জামা বলে কথা। ঈদের আগে দেখে নিলে ঈদ শেষ হয়ে যাবে! কখনো কখনো মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থেকে জামার অপেক্ষায় থেকেছি। যখন জামা আসে ঘরে। দেখে নিয়ে কাছে রেখে তবেই গিয়েছি ঘুমে; তৃপ্তির ঘুমে!
 
এমন করে করে কেটে যায় অনেক অনেক দিন, বছর। সময়ে সময়ে বড় হয়ে যাই। বুঝতে থাকি পরিপার্শ্ব আর বাস্তবতা। ঈদ শুধুমাত্রই জামাসর্সস্ব নয়। এখানে কিছু ব্যাপারও আছে যা ধর্ম বিষয়ক। কিছু আছে আত্মশুদ্ধির সংযম পালন শেষে আনন্দের উপলক্ষ আর কিছু আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। তবু এত কিছু বোঝার পরেও নতুন জামার ব্যাপারটা পিছু ছাড়েনি। আগে যেখানে অপেক্ষায় থাকতাম কখন আসবে। এখন সময়ের পরিবর্তনের পর ব্যাপারটা এমন হয়ে দাড়িয়েছে কখন নিতে যাবো। যদিও নিয়মিতভাবেই পেয়ে যাচ্ছি পরিবার-পরিজন আর কাছের মানুষজনদের কাছ থেকে যা অতিরিক্তই! এখন নিজের আনন্দের পাশাপাশি অন্যের আনন্দকে ভাগীদার করতে সদা সতর্ক থাকতে হয়। পরিবার-পরিজন ছাড়াও কিছু মানুষের কিছু আনন্দের উপলক্ষও আমার হাতের মাঝে জড়িয়ে আছে কোন এক অলক্ষ্যে। যা আমি খুব ভালোভাবে উপভোগ করে যাই।
 
রমযানের ঈদের সময়ে আনন্দটা হয়ে যায় সংযম শেষের আনন্দ। আর এ কোরবানী ঈদ হলো আত্মত্যাগের মহিমা জড়ানো প্রতীকী ত্যাগের উপলক্ষ। এখানেও আছে কিছু নতুন জামা কাপড়ের ব্যাপার। যা অবশ্য খুব বেশি জোরালো নয় কিন্তু অবধারিতভাবেই চলে আসে পূর্ববর্তী ধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। 
 
কোরবানীর ঈদ আবারো এসেছে বছর ঘুরে। ভালো ভাষায় একে বলে ঈদুল আযহা। এ সময়ে সামর্থ্যবান মানুষেরা আরব দেশে গেছেন পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করতে। ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নপ্রাপ্ত ঈশারায় যে কোরবানী চালু করেছেন তাঁর পালন হবে হজ্জ্বের সময়ে এবং আমাদের এখানেও। তাই মোটামোটি সামর্থ্যবানেরা নিজেদের প্রস্তুত করে আছেন নিজেদের সম্পদ দিয়ে কেনা পশু কোরবানীর জন্যে। এই ঈদের দিনে লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানী হবে ইসলামের আদর্শধারার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। কে জানে কার কী মনে! তবে যে ধারা ইসলামের সে ধারার মাধ্যমেই ঈদের নামাযের পরেই শুরু হবে এ পশু কোরবানী পর্ব।
 
ইসলামে কোরবানী প্রথা চালু হয়েছিলো নিজের প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গের ধারণা দিয়ে। তাই ইব্রাহীম (আঃ) যখন প্রিয় ইসমাইলকে (আঃ) উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নেন তখনই আসলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর মনের অবস্থা বুঝে তা কবুল করেছিলেন বলে জানা যায়। তারপর ইসমাইলের বদলে পশু জবাই হয় সে সময়ে। যা ছিলো প্রতীকী। সেই ধারা থেকে এখনো সে প্রতীকী ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু আগেকার সে প্রতীকী অবস্থা যখন মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতা হিসেবে দাড় হয়ে যায় তখনই আসলে বিপত্তি বাধে। যার প্রভাব পড়ে সবখানে, সমাজে থেকে বাজারে। দাম চড়ে উর্ধমূখি। ফলত আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা পড়ে বিপত্তিতে। যে বিপত্তির সরব আলোচনা আছে কিন্তু কোন সমাধান নাই। যাতে করে মধ্যবিত্ত সাধারণের পূর্বেকার আত্মত্যাগের নিয়তের ব্যাপারটা বাজেটে পরিণত হয়। আর যেখানে বাজেটের ব্যাপার ক্রমে উর্ধমূখি হয়ে যায় তখন সে ঈদ আর কোরবানীর ব্যাপার আসলে ইসলামের বিধিবিধানের চাইতে কাগুজে নোটের কাছে বন্দী হয়ে যায়। এতে করে কে জানে আমরা ত্যাগের মুলমন্ত্র থেকে সরে আসি কী-না!
 
 
সময়ের গতির সাথে সাথে আমরা ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি এ পূরনো কথা। এ যান্ত্রিকতায় আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কোনরূপ সমস্যা দেখিনা। কিন্তু কিছু ব্যাপার যেখানে খুবই সেনসিটিভ সেখানে মনে হয় আমাদের সতর্কভাবনা থাকা উচিত। এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থার এবং সামাজিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা ব্যবস্থার রাস টেনে ধরা উচিত। কোরবানী হাটে পশু দাম ব্যবস্থার প্রতিযোগিতাকেই এখানে নির্দেশ করছি।
 
ছোটকালের ঈদের সাথে বড়কালের ঈদের বিস্তর পার্থক্য। এ পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আগেকার সময়ের সাথে এখন যান্ত্রিক ব্যবস্থার সন্নিবেশ হয়েছে তাই মনোভাবনা জগতে আলোড়ন উঠেছে। যার কারণে এক সময়ের ইদ ভাবনা আর এই সময়ের ঈদ ভাবনায় পার্থক্যের দিকে তাকালে পার্থক্যের ধাপগুলোই কেবল দেখা যায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়না। ভাবনার বৈচিত্রের আড়ালে নিজেকে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর! 
 
ঈদ আসে ঈদ যায়। ঈদের আমেজ থেকে যায় কিছু দিন। পরিবার থেকে সমাজ হয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় এর প্রভাব পড়ে। যা অনেকটা ইতিবাচক বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সময়েও মাঝে মাঝে ঈদের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রথা প্রচলন হয়ে আছে আমাদের দেশে। এখানে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্ব পর্যায়ের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় আমাদের খানিকটা আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। আর নেতিবাচক কিছু ব্যাপার যেখানে আসল স্থান দখল করে আছে ব্যবসায়িক কুপ্রবৃত্তি। যার সুযোগে মানুষজনকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় চলে দেদারসে। যার কবলে পড়ে বাড়িমূখো মানুষজন, বাজার-সদাইয়ের জনমানুষ, কিছু হতভাগাজন আর সরকারী আধা-সরকারী অফিসব্যবস্থায় সেবা নেয়া মানুষেরা। এর আসলে প্রতিকার খুব জরুরী। 
 
ত্যাগের মহিমা ধারণ করে যে ঈদ তার অন্তর্গত ভাব ও মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে,সব জায়গায়। ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। এতে করে লাভবান হবে সব এবং সবারই।
 
দৈনিক শ্যামল সিলেট: ০৫-১১-২০১১

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।