শাহবাগ আন্দোলন: কী-বোর্ড চেপে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নাই

01/03/2013 02:02

গণজাগরণ মঞ্চের প্রজন্ম আন্দোলন সারাদেশের মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজকে আবারো উত্থিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর মানুষ সমূহ ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে কণ্ঠে তুলে নিয়েছে 'তুই রাজাকার" শ্লোগান। দীর্ঘদিনের আওয়ামীলীগের করায়ত্ব করা "জয় বাংলা" শ্লোগান আবারো ফিরে এসেছে জনসাধারণের মাঝে। এখন যে কেউ “জয় বাংলা” শ্লোগানে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে দিলেও কেউ বলবে না আওয়ামীলীগার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিকে। এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ অর্জন।

গণজাগরণ মঞ্চের প্রজন্ম আন্দোলন শুরুটা হয়েছিল তীব্র ক্ষোভ আর দাবিকে সামনে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম দাঁড়িয়েছিল ঋজু ভঙ্গিমায় প্রতিবাদে-শ্লোগানে। পরবর্তীতে এর সাথে যোগ হয়েছে সারা দেশের মানুষ। শাহবাগ থেকে প্রজন্মের আলো ছড়িয়ে যায় সারাদেশ এবং দেশের বাইরেও। সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানানোতে অনেকেই বলছেন এটাকে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু এটা মোটেও আদালতকে প্রভাবিত করা নয়। এই দাবি জানানোর মাধ্যমে প্রশিকিউশনকে আরো দায়িত্বশীল এবং দল হিসেবে আওয়ামীলীগ যে কোন ধরনের আঁতাতের সম্ভাবনার বিপরিতে দাঁড়ানো হয়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম মনে করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রশিকিউশনের সাথে জড়িত অনেকেই তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের সময় থেকে শুরু করে মামলার সব পর্যায়ে। শাহবাগ আন্দোলন তাদেরকে দায়িত্বশীল ভূমিকার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছে যা আদালতের এবং বিচারের রায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বিচারকেরা তাদের রায় যুক্তি-তর্ক, তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমেই দেবেন এবং তার প্রতিফলনও আমরা দেখেছি বাচ্চু রাজাকার এবং দেইল্লা রাজাকারের ক্ষেত্রে।

শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ৬দফা দাবি সম্বলিত একটা আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিল। সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল ২৬ মার্চ পর্যন্ত। এর মধ্যে ছিল যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধকরণ। কিন্তু আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করা গেল সরকার এ সম্পর্কে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উপরন্তু এই আন্দোলনের সাথে যারা সংগঠক হিসেবে জড়িত ব্যক্তি হিসেবে নয় ব্লগার হিসেবে তাদের কলম-কীবোর্ড রুদ্ধ করে দিতে চেষ্টা করছে। ৬দফা দাবির একটা উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের মিডিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ কিন্তু সরকারের বিটিআরসি উল্টো বিভিন্ন কমিউনিটি ব্লগে চিঠি দিয়ে কিছু ব্লগারের ব্লগ বন্ধ করে দেবার জন্যে নির্দেশনা এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি প্রদানের জন্যে বলল। এটা তারা কোনমতেই করতে পারেনা। খেয়াল করলে দেখা যায় এই নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের বাক স্বাধীনতা অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বিটিআরসি মনে করেছিল তারা যা বলবে সবাই তা মুখ বুজে মেনে নেবে। কিন্তু যারা একটু-আধটু লেখাপড়া করে এবং সত্যিকার অর্থেই মোসাহেবি ভাবধারাকে লালন করেনা তারা এটাকে মানবে কেন? মানবে কেবলমাত্র সামহোয়্যার ইন ব্লগের মত "জি হুজুর" টাইপ গোষ্ঠী- যা তারা ইতোমধ্যেই করে দেখিয়েছে। ব্লগারদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে তারা মুক্তমতের ধারনার সাথে প্রতারণা করেছে। ধিক্কার জানাই তাদের এ পদক্ষেপকে।

শাহবাগ আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে আল্টিমেটামের একটাও দাবি সরকার কর্তৃক পূরণ না হবার পর মঞ্চ থেকে আরো কঠোর দাবির পক্ষে কথা ওঠেছে। এটা জনমত! আন্দোলনের সংগঠকদের জনমতকে সাথে নিয়েই পদক্ষেপ নিতে হয়। নেতৃত্ব খুব কঠোর আন্দোলনে যায়নি এটা সত্য। চিরাচরিত অহিংস পদ্ধতিরই আশ্রয় নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচির দাবির বিপরিতে কর্মসুচি দিয়েছে স্মারকলিপি প্রদানের। এখানে অনেকেরই আপত্তি। অনেক সংগঠন আবার নিজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসুচি দিয়েছে। ফলে অনেকেই ব্যাপারটিকে বিভক্তি হিসেবেই দেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে এখানে বিভক্তির কিছু নেই। কারণ যাবতীয় কর্মসুচির মূলে রয়েছে একটাই দাবি সকল যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসি এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণ। যদি একই সমাবেশ কিংবা মঞ্চ থেকে দাবির বাইরে কোন দাবি ওঠতো তবেই একে বিভক্তি বলা যেত। এ নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে অনলাইনে তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। কর্মসুচিভিত্তিক এই মত-মতামত-ভিন্নমত আসল লক্ষ্য থেকে কাউকেই বিচ্যুত করেনি এবং করতেও পারে না।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, যখন অনলাইনে কর্মসুচিভিত্তিক ভিন্নমত নিয়ে সবাইই হাজির তার বিপরিতে জনমানুষের প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষ কর্মসুচিকে অহিংস পদ্ধতিতে দেখতেই চায়। সহিংস কর্মসুচির বাইরে কোন আন্দোলন যে এভাবে দিনের পর দিন টিকে আছে এটা একটা মাইলফলক হিসেবে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে মানুষের মনে। তাই শাহবাগ আন্দোলন সাধারণ মানুষের কাছে অনুরেরণার উৎস হিসেবেই কাজ করছে। এই আন্দোলনের কে নেতা আর কে নেতা নয় তা নিয়ে কেউ ভাবে না। কিন্তু ভাবে আসল লক্ষ্যে তারা স্থির আছে কি-না! আশার কথা, এখনো এই আন্দোলন টিকে আছে এবং থাকবেও। যদি কোন কর্মসুচি সহিংস পদ্ধতিতে হয় তবে মানুষ যে হতাশ হবে তা বলা বাহুল্য।

কিছু মিডিয়া এবং অনলাইনে ইতোমধ্যেই শাহবাগ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ইমরান সরকার ব্যর্থ হয়েছেন বলে রব ওঠেছে। অনেকেই এই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। নেতৃত্ব বদলাবার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এই পরামর্শ পরামর্শ হিসেবেই থেকে গেছে। পরামর্শদাতার মুখ থেকে অন্য কারো নাম উচ্চারিত হয়নি যে কিনা নেতৃত্বে আসবে! অনেকেই এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রঙ লাগাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বলেছেন, এখানে আওয়ামী ছাত্রলীগ এবং বাম নেতাদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। অথচ খেয়াল করলে দেখা যাবে, যখন এই আন্দোলনের ডাক আসে তখন মানুষ সাড়া দিয়েছে এবং কেউই দেখেনি কে নেতৃত্বে আছে এবং কে কে থাকবে। কেউ যেমন ইমরান সরকারকে দেখে আসেনি তেমনিভাবে অন্য কারো ডাকেও কেউ আসেনি। মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে এসেছে চেতনা থেকে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে। সময়ে সময়ে এ আন্দোলন থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে না আসলে সেটাই হত অবাক করা ব্যাপার। এখানে ইমরান না হয়ে অন্য কেউও হয়ে যেতে পারতো!

এই আলোচনা-সমালোচনাতে অনেকেই পারঙ্গম বুঝা যায়। তবে আলোচক-সমালোচকদের প্রতি অনুরোধ দয়া করে আপনাদের কীবোর্ডের ধাক্কায় শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে কোন ধরণের বালখিল্য সমালোচনায় মেতে ওঠবেন না। সমালোচনা আন্দোলনের গতিপথকে সমৃদ্ধ করবে, যে কোন ভুল-ত্রুটিকে ধরিয়ে দেবে। কিন্তু অতি সমালোচনা এবং অতি সুশীলপরায়ণতা আন্দোলনের গতিপথকে কন্টকাকীর্ণ করে বিভ্রান্ত করে দিতে পারে অনেককেই। এ পর্যন্ত অনেক আলোচনা-সমালোচনা সংগঠক বলে যারা আছেন বলে দৃশ্যমান হচ্ছে তাদেরকে সঠিক পথে রাখতে পেরেছে।

গণজাগরণ মঞ্চের সাথে অনেকগুলো সংগঠন আছেন তারা একই সাথে আন্দোলন করে যাচ্ছে। মুল মঞ্চের সাথে তাদের আন্দোলন এবং সেই সাথে ভিন্ন ভিন্ন আন্দোলন এই জাগরণকে স্থায়িত্ব দেবে সন্দেহ নেই। অন্যান্য সংগঠনের কর্মসুচিকে বিভক্তি হিসেবে এখানে দেখার সুযোগ নাই, দরকার নাই অপপ্রচারের। অপপ্রচারের মুল দায়িত্ব(!) যেহেতু মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ গংদের হাতে সেহেতু আন্দোলনের সাথে যারা সংশিষ্ট ছিলেন এবং আছেন তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব(!) মুল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবে। শহীদ রুমী স্কোয়াড অনশন কর্মসুচি পালন করছে। তারা করতেই পারে। এই কর্মসুচি গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখার সুযোগ নাই। এটাকে দেখা যায় দাবি আদায়ের সম্পূরক কর্মসুচি হিসেবেই।

৫০দিনের আন্দোলনে ৪২ বছরের জঞ্জাল শেষ হবার নয়। এর জন্যে সময়ের প্রয়োজন। আন্দোলন শুরু হতে পারে মুহুর্তের মধ্যে। কিন্তু তার ফল আসে ধীরে। এবং ধীরে আসা ফলাফলের সুফল ভোগ করা যায় অনন্তকাল ধরে। এই আন্দোলনের ফলে নতুন প্রজন্ম প্রবল সাহসে রাজাকারদের বলতে শিখেছে “তুই রাজাকার”। এটা অনেক বড় অর্জন। আজকের প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বীজ বপন হয়েছে তা লালন করে তাকে সুস্থ চিন্তার পরিবেশ দেয়া খুব দরকার। এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে গ্রহণ করেছে বলেই আমরা আশাবাদী হচ্ছি। এই আশাবাদ এই গণজাগরণ আন্দোলনের সাফল্য। এ সাফল্যের পথ ধরেই আমরা হেঁটে যেতে চাই অনন্তকাল; রাজাকারমুক্ত আর জামায়াত-শিবিরমুক্ত বাংলাদেশকে নিয়ে।

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।