শাবি'তে নির্মাণাধীন মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য হবে; হতেই হবে

10/01/2013 23:25

৩ মে সোমবার ১৯৭১।

রুমী বইটা আমার হাতে দিয়ে বলল। ‘আম্মা এই বইটা তুমি পড়লে মনে অনেক জোর পাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি অতর্কিত আক্রমণ করে পোল্যান্ড দখল করে নেবার পর সেখানে পোলিশ ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে পোলিশরা যে অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারই কাহিনী এটা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত কিভাবে তারা লড়াই করে গেছে, লড়াই করে মরেছে, তবু মাথা নোয়ায়নি, তারই কাহিনী এটা।

এই বই পড়লে তোমার মনের সব ভয় কেটে যাবে, সব দুঃখ তুচ্ছ হয়ে যাবে। জার্মানরা ইহুদিদের মানুষ বলে গণ্য করত না। পশ্চিম পাকিস্তানিরাও আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, মুসলমান বলেও গণ্য করে না। অথচ ওদের চেয়ে আমরা বহুগুণে খাঁটি মুসলমান। পড়লে তুমি বুঝতে পারবে, এই বইতে যা লেখা আছে, দেশ ও জাতি বদলে দিলে তা অবিকল বাংলাদেশ আর বাঙালীর দুঃখের কাহিনী, প্রতিরোধের কাহিনী, বাঁচা মরার লড়াইয়ের কাহিনী বলে মনে হবে।' (একাত্তরের দিনগুলি,১৪শ মুদ্রণ,পৃ: ৮০-৮১)"


শহীদ রুমী তাঁর মা জাহানারা ইমামকে এসব কথা বলেছিলেন যুদ্ধে যাবার অনুমতি নিতে। উদ্দেশ্য মা'কে প্রভাবিত করা। কারণ রুমী তাঁর মা’র অনুমতি ছাড়া কিছুই করতেন না। এ প্রসঙ্গে জাহানারা ইমাম লিখেছেন, রুমী যদি আমাকে না জানিয়ে যুদ্ধে যেত, আমি বেঁচে যেতাম। এখানেই মা-পূত্র আর দেশাত্মবোধ একাকার হয়ে যায়। শহীদ রুমীকে জাহানারা ইমাম যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন এবং প্রাণপণ যুদ্ধ করে এই রুমী শহীদ হলেন। জাহানারা ইমাম আর রুমী এভাবেই একাত্ম হয়ে যান বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) প্রশাসন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং শহীদ রুমীর আদলে মুক্তিযুদ্ধের যে ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ করে। মা’র কাছ থেকে সন্তান মুক্তিযুদ্ধের যাবার অনুমতি নিচ্ছে আর মা তাঁকে বাঁধা না দিয়ে আশীর্বাদ করে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাচ্ছেন অন্তর্হিত ভাবের দিক থেকে এটা একটা ইতিহাস। নির্মিতব্য এই ভাস্কর্য আমাদের ইতিহাসকে যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করে সেই সাথে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা আর একাত্তরের সব মা’কে এবং মুক্তিযুদ্ধকেও শ্রদ্ধার এক অভাবনীয় নিদর্শন।

মানব সভ্যতা বিকাশ আর শুরুর প্রথম দিক থেকেই ভাস্কর্য আর চিত্রকলা এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। যখন মানুষের মুখের এবং হাতের কোন স্বীকৃত ছিল না তখন থেকেই এর শুরু। মানুষের মন ভাব প্রকাশের আর রুচির বিচিত্রতা আর ভিন্নতার প্রকাশভঙ্গী এই ভাস্কর্য ও চিত্রকলা। দিনে দিনে মানুষের মুখের এবং হাতের ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়েছে কিন্তু সেই আদিকালের স্বীকৃত ভাস্কর্য-চিত্রকলা এখনো হয়ে আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য আর রুচিবোধ প্রকাশের মাধ্যম। পৃথিবীর প্রতি দেশ এভাবে তাঁর ইতিহাসকে ধারণ করে স্থাপত্য আর ভাস্কর্য্যের রূপের মাধ্যমে। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি চেতনা আর ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতাকে গ্রহণ করেছে পৃথিবীর সব দেশই এমনকি আরব দেশগুলোও।

সাধারণ অর্থে একটা বিরোধিতা লক্ষ্যনীয় যে, ভাস্কর্যকে নাকি ইসলাম সমর্থন করে না। এই কথা ভিত্তি যে দূর্বল তা প্রমাণ করে দিয়েছে আরব দেশগুলো। সৌদি আরব, মিশর, কুয়েত, ইরাক, ইরান, সুদান এমনকি পাকিস্তানেও ভাস্কর্য তাদের স্বীয় স্বীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইসলামের বিরুদ্ধে গেলে এসব ভাস্কর্য অন্যান্য দেশেও বিরোধিতার সম্মুখিন হত। কিন্তু সে রকম কোথাও কি হয়েছে; হয় নি! তাহলে আমাদের বাংলাদেশে কেন হয়, কেন হচ্ছে? উত্তর পরিষ্কার- যারা এর বিরোধিতা করছে তারা খুবই সচেতনভাবেই তাদের নিজস্ব চিন্তাকে চাপিয়ে দিতে চায় ধর্মের দোহাই দিয়ে! অথচ ইসলামের পীঠস্থান বলে পরিচিত সৌদি আরবেও ভাস্কর্য রয়েছে; তেমনিভাবে আরবের আরবের অন্যান্য দেশগুলোতেও। শাবি'র মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের যারা বিরোধিতা করেন তারা প্রায় সবাইই আদর্শ ভাবেন আরব দেশগুলোকে। এই ভাস্কর্য নির্মাণ বিরোধিতাকারী তাদের অনেকেই মাহফিলে যে "নাত" পাঠ করেন তার অনেকটাই লেখা পারস্যের কবি শেখ সাদীর। সেই শেখ সাদীর মাজার আছে আজকের ইরানে এবং সেখানে তাঁর মাজারের সামনেই রয়েছে একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য। কঠোর ইসলামী অনুশাসনের দেশ ইরানের গোলেস্থান স্কয়ারে আছে শেখ সাদির আরেকটি ভাস্কর্য। সেখানে তবে ধর্ম অবমাননা হয় নি!

ভাস্কর্য যেখানে ইসলামের এবং আরব দেশগুলোর ইসলামি আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হয় নি সেখানে আমাদের এখানে কেন হবে? সারা বিশ্বে যেহেতু একই ইসলাম তবে বাংলাদেশে এসে কেন অন্যথা হবে! সারা বিশ্বের ইসলাম এবং বাংলাদেশের ইসলাম যেহেতু একই এবং মুসলিম দেশগুলো যেখানে তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে চর্চা করতে ভাস্কর্য নির্মাণ ও সংরক্ষণ করে সেখানে বাংলাদেশে এর বিরোধিতাকে স্পষ্টতই উদ্দেশ্যপূর্ন। এখানে যেমন “অতিইসলামী” যা প্রকৃতভাবে গোঁড়া মানসিকতা ঠিক সেভাবে কাজ করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শাবি’তে চেতনা-৭১ নামে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য রয়েছে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে একটা হলের নামকরণ শাবি'তে এবং সিলেটে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। যারা ছিল এবং আছে এর নেপথ্যে এরা আবারো একই পথে যাচ্ছে যখনই দেখেছে ক্যানভাসে জাহানারা ইমাম এবং রুমীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ হচ্ছে। যখনই মুক্তিযুদ্ধ, যখনই জাহানারা ইমাম তখনই বিরোধিতা এবং এর বিরোধিতা চলে আসে ইসলামের নাম নিয়ে। কারণ এরা চিহ্নিত এবং সব সময়েই ইসলামকে নিয়ে সামনে নিয়ে আসে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক চেতনার নাম জাহানারা ইমাম, তিনি আত্মত্যাগের এক দলিলের স্মারক। মুক্তিযুদ্ধের ছেলে-স্বামী সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন কিন্তু দমে যাননি।তিনি যখন দেখেছিলেন এদেশে কুখ্যাত রাজাকারেরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে রাজনীতি করছিল তখন তিনিই সর্বপ্রথম রুখে দিতে জনতাকে জাগিয়েছিলেন। তিনিই বাংলাদেশে গণআদালত করে স্বাধীনতাবিরোধি কুখ্যাত রাজাকারদের প্রতীকী বিচার করেছিলেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না এই অন্ধকারের পূজারিদের।

শাবি’তে নির্মাণাধীন মুক্তিযুদ্ধের এই ভাস্কর্য হবে এবং হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার সেখানকার কয়েকজন শিক্ষক সংখ্যা মানে যারা মাত্র ৫১ তারা এর বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে। তাদের আসল বিরোধিতা যে মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তা পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধ এবং জাহানারা ইমাম ইস্যুতে তারা ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সাথে মিলে-মিশে একাকার। এ থেকে পরিষ্কারভাবেই প্রতীয়মান হয় যে তারা কোন চেতনা আর বিশ্বাসকে ধারণ করে। শাবি’র নির্মানাধীন ভাস্কর্যটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ করে আর এর বিরোধিতা মানে সরাসরি চেতনার সাথে বিরোধিতা। ব্যাপারটি প্রকৃত অর্থেই দুঃখজনক যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও ভাস্কর্যের শিল্পমূল্য এবং চেতনার অন্তর্হিত ভাব বুঝতে অক্ষম।

শাবি’তে নির্মানাধীন ভাস্কর্য হবে এবং তা হতেই হবে কারণ এখানে পরাজয় মানে আমাদের পেছনের দিকে হেঁটে যাওয়া। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আমরা পেছনের দিকে হেঁটে যেতে চাই না। যখন দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে, যখন আমরা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক ব্যর্থতার পরেও এগিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন পরাজয় মেনে নেয়া কষ্টকর বৈকি!

যে ৫১জন শিক্ষক এই ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে যারা সিলেটে এর বিরোধিতা করেছে ইতিহাস ঘাঁটলে হয়ত দেখা যাবে তাদের অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধ চেতনাকে ধারণ করে না। এমন লোকেরা মিছিল মিটিং করছে এবং জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিতে গেছে যাদের কেউই জীবনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা পর্যন্ত যাবার যোগ্যতা রাখে না। এরা কেউই জনমানুষের কোন প্রতিনিধিত্ব করে না এবং সিলেটবাসীর আবেগ সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়। তাদের গলার জোর আর পেশিশক্তিতে এই ভাস্কর্য নির্মাণ কোন ক্রমেই থামতে পারে না; উচিতও নয়।

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।