জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিকল্প নাই

20/03/2013 01:32

২৬ মার্চের আগে একাত্তরের ঘাতক ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সংশোধিত ট্রাইব্যুনালস আইন অনুযায়ী অভিযোগ গঠন এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে আইনি-প্রক্রিয়া শুরু করা। অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠনের আর্থিক উৎস চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং এ বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া গতিশীল করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দেয়া। গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান জোরদার করা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত-শিবিরের মুখোশ উন্মোচন করা এবং তাদের রক্ষক ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।

এমনটাই ছিল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবি সম্বলিত আল্টিমেটাম। এবং এর জন্যে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল ২৬ মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু অদ্যাবধি এ সম্পর্কিত কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় নি বলে অনুভূত হচ্ছে। তাহলে কি সরকার পাত্তা দিচ্ছে না তারুণ্যের গণজাগরণ প্রজন্ম আন্দোলনকে। আল্টিমেটামের প্রায় মাস সময় পার হবার পরও এ সম্পর্কিত কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হওয়ায় তেমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে কি সরকার আন্তরিক না দাবিপূরণে?

শাহবাগের জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণের সময় বেঁধে দেবার পর সরকার দলীয় নেতাদের মুখ থেকে ইতিবাচক কথা শোনা গেলেও এই মুহুর্তে এসে তা মিইয়ে গেছে। এমনকি জাতীয় সংসদেরও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু হতাশার বিষয় যে সরকার দলীয় নেতা ও মন্ত্রীরা আলোচনায় অংশ নিয়ে নিষিদ্ধের পক্ষে কথা ও দাবি তুলেছেন যারা তারা নিজেরা এই সম্পর্কিত বিল অথবা প্রস্তাব উপস্থাপনেরই কথা। মানুষ তাদের কাছ থেকে দাবি জানানো মেকি ব্যাপার শুনতে আগ্রহী ছিল না। তাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল বিল আনার এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন ছিল তা পাস করে অথবা অন্যান্য বিবিধ উপায় যা সঙ্গত তা দিয়ে জামায়াত-শিবির নামক বিষবৃক্ষের উৎপাটন। কিন্তু তা না করায় সরকার ও আওয়ামীলীগের এই পদক্ষেপ হতাশ করেছে সন্দেহ নেই।

সরকারের ভুল পদক্ষেপ এবং অতিরাজনীতিকরণের কারণে জামায়াত-শিবির সারাদেশে ত্রাসের যে হোলিখেলা খেলেছে সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ে তাতে করে এক বাক্যেই এই দলটিকেই নিষিদ্ধ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অথবা বলা যায় পরবর্তী নির্বাচনের ঢাল হিসেবে ব্যবহারের কারণে তারা একে পুষে রাখছে। ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছে বিষয়টি এখন আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে চলে এসেছে যেহেতু জামায়াত নিষিদ্ধকরণের/নিবন্ধনের রিটটি শুনানির অপেক্ষায় আছে উচ্চ আদালতে। কিন্তু এই যুক্তি যে ধোপে টেকে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী এই দলটি নিষিদ্ধ করা যায় যে কোন সময়। সংবিধানের এই ধারার দিকে চোখ বুলালে দেখা যায় সেখানে আছে:

জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবেঃ তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উক্তরুপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি-
(ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়,সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
(খ) উহা ধর্ম,গোষ্ঠী,বর্ণ,নারী-পুরুষ,জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
(গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;বা
(ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।"

এখানে স্মর্তব্য যে, ধর্মীয় উস্কানি সৃষ্টি করে সারাদেশে একাত্তর সালেই শুধু না এই তেরো সালেও সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘর-বাড়ি, মন্দিরে হামলা ও লুট করেছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও প্রমাণিত তাদের শীর্ষ নেতাদের কিছু হলে দেশে “গৃহযুদ্ধ” বাধিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। দলটির গঠনতন্ত্র গণতান্ত্রিক এবং সংবিধানসম্মত নয় যা এখন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। উল্লেখিত সবগুলো কারণই সংবিধানের ৩৮ ধারাকে সমর্থন করে না বলে এই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে সাংবিধানিকভাবে কোন সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা ছিল না।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০(১) ধারায় লিখা আছে- No person shall form, or be a member or otherwise take part in the activities of, any communal or other association or union which in the name or on the basis of any religion has for its object, or pursues, a political purpose. আইনের এই ধারানুযায়ী হরকতুল জেহাদ, জাগ্রত জনতা, জামিয়াতুল মুজাহিদীন এবং হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। জঙ্গি এই সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করার জন্যে একই আইনের ২ উপধারা অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সংবিধানের ৩৮ ধারা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারা অনুযায়ি জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আইনগত কোন জটিলতার মধ্যে পড়তে হত না।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয় ১৯৪১ সালে । ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরে “জামায়াতে ইসলামী হিন্দ” নামে দলটা গঠিত হয় । ভারতবর্ষের কম্যুনিস্ট বিরোধী শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদীদের আশ্রয়ে দলটির জন্ম । তাদের জন্মের ইতিহাসের সাথে সাথেই নতুনত্বের বিরোধিতার প্রবণতা চলে আসে। জন্মের পর তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদূদী ঘোষণা করেন পাকিস্তান রাষ্ট প্রতিষ্ঠার দাবি যারা করে তারা মানে তৎকালীন মুসলীম লীগ, জিন্নাহ এরা কেউই “খাটি মুসলিম” না। মুসলমানিত্বের দোহাই তাদের সবকিছুতে ছিল বলে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তারা আবারো “খাটি মুসলিম,কাফের-মুশরিক” তত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাদের সে অপচেষ্টা সফল হয়নি, স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ তাদের বিরোধিতা এবং গণহত্যাকে উপেক্ষা করে।

জামায়াত-শিবির আদতে কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নয় তা সময়ে সময়ে প্রমাণ হয়েছে। আবারো প্রমাণ হল সারা দেশে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের কাঁধে সওয়ার হয়ে তারা মসজিদে আগুন, আমাদের চেতনার সৌধ শহীদ মিনারে হামলা আর কোনরূপ কারণ ছাড়াই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর স্থাপনা ভাংচুরের মাধ্যমে। এটা তাদের পরিচিত রূপ এবং ঐতিহাসিক সত্য যে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তারা বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) মানুষকে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে গণহত্যায় নেমেছিল। এবার মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর আবারো একইভাবে এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষকে হত্যার মিশনে নেমেছে ইসলামবিরোধি/নাস্তিক আখ্যা দিয়ে। এটা চিরন্তন যে একাত্তরেও তারা পরাজিত হয়েছিল এবং এই ২০১৩ সালেও যে পরাজিত হবে বিভিন্ন আলামতে তা পরিষ্কার।

জামায়াত-শিবির মুখে ইসলামের বুলি আওড়ায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কোন আদর্শ ও রীতিনীতি ধারণ করেনা। তাদের সর্বোচ্চ নেতাদের বেশিরভাগই কোন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেনি। তারা মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও মাঝে মাঝে কথা বলে। অদ্ভুত! রগ কাটা, মানুষ হত্যা,আক্রমণ, অগ্নিসংযোগে তারা সংযুক্ত।তাদের সর্বোচ্চ নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মওদুদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল কিন্তু যদিও পরে তা কার্যকর হয়নি পাকিস্তানের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে। এবং বাংলাদেশেও তাদের সর্বোচ্চ নেতাগুলোও একইভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে এখন শাস্তির প্রহর গুনছে। এ থেকে পরিষ্কার যে জামায়াত-শিবির তাদের দলীয় ঐতিহ্য যা একান্তই নোংরা এবং দেশদ্রোহিতামূলক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে অদ্যাবধি।

স্বাধীনতার চার দশক পর প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধার দেশের সর্বত্র জেগে ওঠেছে। এই মুহুর্তে জামায়াত-শিবির বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত একটা রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন যারা নিয়ত দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। সারা দেশ জেগে ওঠেছে এক দাবিতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের জন্যে। ঠিক সেই মুহুর্তে তাদেরকে বাচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি নামসর্বস্ব ইসলামী দল।যদিও বিএনপি প্রকাশ্যে রাজপথে নাই তবুঅ তারা বিভিন্নভাবে তাদেরকে সমর্থন যুগিয়ে চলেছে। এই সব নামসর্বস্ব ইসলামী দলগুলোর অনেকেই মুখে জামায়াত-শিবির বিরোধিতা করে কিন্তু অন্তরে তাদের লক্ষ্য ও ভাষা একই। যা প্রমাণ করেছে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তে আমাদের শহীদ মিনার ভাংচুর ও জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়ার মাধ্যমে।

জামায়াত-শিবিরের এই তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমও। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় হুমায়ুন আজাদ কথা। তিনি বলেছিলেন,”মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা,মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা,তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক,আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক”। এ থেকে ধর্মব্যবসায়ীদের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই মুহুর্তে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু এবং গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে জামায়াত-শিবির স্পষ্টতই বেশ বেকায়দায়। তাদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের বেশ ভাল দাওয়াই দিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্য জামায়াত-শিবির বিরোধিতার নাম নেয়া অন্যান্য কিছু ইসলামী দল। এই সব ইসলামী দল এভাবে জামায়াত-শিবিরের পেটে ঢুকে যাবে তা অনেকেই ভাবতে না চাইলেও অবাস্তব কিছু না।

ব্লগারদের নামে কুৎসা রটনা, আস্তিক-নাস্তিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি, সন্ত্রাস, চাঁদে সাঈদীর মুখ নিয়ে গুজব সৃষ্টি করে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানা স্পষ্টতই ইসলামের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক! সেই সাথে ধর্মের নাম নিয়ে মসজিদে আগুন দেয়া, চেতনার সৌধ শহীদ মিনারে হামলা-ভাংচুর এবং জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়া ধর্মের কোন রীতিতে লেখা আছে? এর সাথে তাল মিলাচ্ছে যারা তাদের প্রতিও একই প্রশ্ন। যদিও জানি যারা উগ্র এবং সন্ত্রাসী তাদের কাছে উত্তর চাওয়াটা বোকামো এবং অরণ্যে রোদন!

গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষিত এবং সারাদেশের মানুষের অভিন্ন দাবি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিটি নিয়ে এখন খুব বেশী আলোচনা হচ্ছে না বলে আদতে কি এই দাবি চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের মন থেকে। গত কিছুদিনের সন্ত্রাস, হিংস্র রূপ এবং বাংলাদেশের জন্মের সাথে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা বলে দিচ্ছে এদেশে তাদের রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই। এই মুহুর্তে সারা দেশের সচেতন মানুষের এক দাবি- জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। বাংলাদেশ নামক দেশের অস্তিত্ব আর শৃঙ্খলার স্বার্থে এ দাবি পূরণের বিকল্প কিছু নাই।

 

 

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।