ঘোমটা নিয়ে মিতা হক কি বলেছেন, কেন বলেছেন?

13/08/2013 00:56

রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হকের বক্তব্য নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। শুনে, না শুনে হুজুগেরা তাঁর চৌদ্ধগোষ্টী উদ্ধার করে ফেলেছেন। অনেকেই আবার বাঙালির পোশাক ঘোমটা হবে কি না তা নিয়ে রীতিমত তুমুল বিশ্লেষণি বক্তব্যও ঝেড়েছেন। তবে এই প্রথম শোনা কথা বাঙালির পোশাক ছিল ঘোমটা যদিও যা জানি তা হলো এই ‘খানিক ঘোমটা’ একটা অভ্যাস কিংবা রুচি ছিল গ্রাম্য সমাজের যা অনেক দিন ধরেই বহমান ছিল। কিন্তু বাঙালির পোশাক ঘোমটা এমন অদ্ভুত ঘোষণা সম্ভবত এবারই প্রথম!

মিতা হকের বক্তব্য পুরোটা শোনার মত ধৈর্য্য আমাদের অনেকেরই নাই তা ছিল অনুমিতই। এবং বাস্তবতা এর থেকে ভিন্ন কিছু না। ফলে চিলের পেছনে ছোটার মত মানুষের ‘পণ্ডশ্রম’ শামসুর রাহমানের সে কবিতার মতই এক সময় তা প্রমাণ হবে। কিন্তু এই প্রমাণের আগে কিছু লোকের ফাঁকা মস্তিস্কের সপ্রতিভ উপস্থিতি এত সহজে হয়ত আশা করিনি। কিন্তু অতি নির্মম বাস্তবতা এমনই!

মিতা হক হঠাৎ করে এমন তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ার মুল কারণ তার বক্তব্য বিকৃত অথবা আংশিকভাবে প্রচার। আংশিক বক্তব্য যে কোন বক্তব্যকে সমালোচনার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আর তা যদি হয় ইচ্ছেকৃত তাহলে সমালোচনার পাল্লা ভারি হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। মিতা হকের বক্তব্যের পর তাঁর বাঙালিত্ব নিয়ে যারা প্রবল আলোচনায় মেতেছিলেন তারা নিজেরা কতখানি ধারণ করেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না কিন্তু কেন তুলোধুনো করার প্রাণান্ত পণ তাঁর পেছনে নিশ্চয়ই অনেকগুলো কারণ রয়েছে। খুব সাধারণভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে মিতা হক তাঁর বক্তব্যে যে সব বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তা হলো: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের প্রশংসা, বাংলাদেশি এবং বাঙালি নিয়ে প্রশ্ন। কারণ জাতিতে আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি তা নিয়ে আমাদের অনেকেরই মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ রয়ে গেছে। যা কেবলই রাজনৈতিক বিশ্বাসের মাধ্যমেই ধারিত এবং জামায়াত-শিবিরের হরতাল নিয়ে সরাসরি কথা বলা। যেখানে উল্লেখ ছিল ধর্মের কথাও।

মিতা হক প্রথমে তাঁর বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন একমাত্র আওয়ামীলীগ সরকারই তা শুরু করেছে। বক্তব্যের এই সূত্র থেকে শ্রেণিভেদে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কিছু মানুষের বিরাগভাজন হবার যে আশঙ্কাটুকু ছিল তা সময়ের সাথে সাথে ব্যপ্তি বেড়েছে। একসময় তিনি ঈদের পর পরই ডাকা জামায়াত-শিবিরের হরতাল নিয়ে কঠিন শ্লেষমাখা কথা বলেছেন। তা অনেকেকেই সহজভাবে নেবে কেন? মিতা হকের বক্তব্যের একটা পর্যায়ে ছিল বাঙালি এবং বাংলাদেশি নিয়ে। সংবিধান অনুযায়ি আমরা হয়ত বাংলাদেশি কিন্তু জাতিসত্ত্বায় আমরা প্রকৃত বাঙালি তা সত্য। কিন্তু অতি রাজনীতিকরনের ফলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দলীয় শ্লোগানের মত হয়ে গেছে।  তাই অনেকেই আমাদের মুল পরিচয় বাঙালি তা ভুলে যাবার এবং ভুলিয়ে দেবার চেষ্টায় থেকেছেন সব সময়। শুধুমাত্র আদিবাসীরা বাংলাদেশি আর বাকি সবাই বাঙালি তা মানবে কেন তারা যারা অতি রাজনীতিকরনের বলি কিংবা মত্ত?

মিতা হকের বক্তব্যের যে অংশটুকু নিয়ে তীব্র বিতর্ক এবং আলোচনা-সমালোচনা তার মধ্যে ছিল ঘোমটা। অনেকেই আবার একে বলছেন তিনি ঘোমটা নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন। অথচ খেয়াল করলে দেখা যায় তিনি বাঙালিদের পোশাকের আংশিক বর্ণনার আগে বলেছেন-“ঘোমটা আমি খুব পছন্দ করি। আমার মা-খালারা একটা পুরুষ মানুষ ঘরে এলে একটা আচল টেনে ছোট্ট একটা ঘোমটাও...”। এখানে তাঁর ঘোমটাকথন সত্যিকার অর্থেই ঘোমটা তত্ত্ব নিয়ে বিদ্রূপের কৌশল না। তিনি বাঙালির পোশাক শাড়ির কথাকে গুরুত্ববহ করে তুলতে ঘোমটার কথা এনেছেন এবং এর আগে নিজেও তার পছন্দের কথা বলেছেন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সত্যি সত্যিই কি ঘোমটা বাঙালির পোশাকের মধ্যে পড়ে? আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, কোনকালেই ঘোমটা বাঙালির আদি পোশাকের মধ্যে ছিলনা। আরবের বেদুইনরা প্রবল মরুঝড় ঠেকাতে যেখানে শুধুমাত্র সামনের রাস্তা দেখার জন্যে চোখগুলো বের করে রাখত এবং স্বাভাবিকভাবেই সারা শরীর কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাখতো এক সময় তা প্রবল ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কিছু লোক হয়ত একে ধর্মীয় পোশাক বলে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে। অথচ এই পোশাক হয়ত ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ হয় নি কিন্তু গ্রাম্য সহজাত ধর্মীয় কিংবা আচরণের কারণে সমাজের কিছু অংশের মধ্যে প্রবলভাবে বাসা বাঁধতে পেরেছিল। যা আমাদের বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি যাই বলা হোক না কেন এই সংস্কৃতির কোন অংশ হয়ে কণ কালেই দাঁড়ায় নি এবং দাঁড়াবেও না।

স্বীকার করি কিংবা নাই করি, গত কয়েক মাস ধরে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে লোকদেখানো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। বিশ্বাসের দিকটা পুরোপুরি অন্তর্গত হলেও বিশ্বাসের অতি প্রকাশের বাড়াবাড়ি হেফাজতিদের আবির্ভাবের পর পরই। এর সাথে রাজনৈতিক যোগ যে রয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভিন্ন ভাবনার অবকাশ নাই। এই অতি ধর্মীয় মনোবৃত্তি আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে ভিন দেশি সংস্কৃতিকে অথবা আচরণকে আঁকড়ে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা। অনেকেই এই সূত্রে আমাদের সংস্কৃতির সাথে ঘোমটার যোগসূত্র খুঁজে একে বাঙালির পোশাক বলেও মুখে ফেনা তুলতে চাচ্ছে। সচেতনভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় এর মধ্যে প্রবল রাজনৈতিক বিশ্বাসের যোগসূত্র যে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

টকশোতে অনেক বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বরা আসেন। আমরা তাদের কথা শুনি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রভাব থাকে অনেক দিন। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ইদানিংকার ফেসবুক ইস্যুনির্ভর। যে কোন ইস্যুতে অনলাইন পাড়া সরগরম থাকে। অনেক রথিমহারথিরা নিমিষেই এখানে খেলপুতুল হয়ে যান। মিতা হকের এই বক্তব্য সত্যিকার অর্থেই ইস্যুর খোঁজে থাকা ফেসবুকারদের অতি প্রতিক্রিয়া। যত বেশি বিকৃত তথ্য এবং আলোচনা-সমালোচনা ততবেশী আনন্দ ও খ্যাতির উপলক্ষ্য। আমরা ছুটছি কখনো প্রকৃত আনন্দের সন্ধানে, কখনো সমাজ পরিবর্তনে আবার কখনো বিকৃতের উদ্দেশে।

 

কি বলেছিলেন মিতা হক:

"...প্রথমে আমি বলব, এই সরকারকে সাধুবাদ জানাবো এই সরকারই হচ্ছে is the only option একমাত্র দল যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলছে। বলছে, চেষ্টা করছে। এবং এ সরকারই একমাত্র দল যারা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথা বলছে। আমরা মুল জায়গাতে যাই না এই যে প্রতিদিন একাত্তরে, এটিএনে প্রতিদিন নানা চ্যানেলে অনেক গুণী ব্যক্তিরা তাদের কষ্টের কথা, তাদের পাওয়া না পাওয়া কথা তাদের মেধা দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করছেন। কিন্তু মুল জায়গাতে দাড়াচ্ছিনা না কেন? আমার কাছে মুল জায়গাটা হচ্ছে, আমাদের একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে । আমাদের দেশ বাংলাদেশ, এখানে বিভিন্ন ধরণের লোক বাস করে। কিন্তু আমরা এখানে শুধুমাত্র আদিবাসীরা আদিবাসী বাংলাদেশি এবং বাকি সবাই কিন্তু বাঙালি। বাঙালি যারা ঈদের দুই দিন পর হরতাল ডেকেছে তারা পরিচিত ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে। তারা জানে না ,তারা বাড়ি যাবে না, ফিরবে না, তারা কিসের বিরুদ্ধে কাজটা করছে? ধর্মের বিরুদ্ধে কাজটা করছে। ঈদ ত ধর্মীয় উৎসব। আমি বলছি, আমাদের পরিষ্কার একটা জায়গা, এই যে রেখা আছে যে আমি আমার ধর্মের চর্চা, ধর্মের কাজ সেভাবে করব যে আমাদের একটা কমন পরিচয় থাকবে।  

আজকে তুমি আর আমি যে শাড়ি পরে বসেছি, মামুন ভাই, তারিক ভাই পাঞ্জাবি পরে বসেছে কেউ দাড়ি টুপি লাগিয়ে নেই কেউ এমন লম্বা সিঁদুরে টিপ পরে নেই। কেউ হিন্দু-শিখ আমাদের কমন পরিচয় আছে। আমরা, ছেলেরা এক ধরনের পোষাক পড়বে, মেয়েরা এক ধরনের পোষাক পড়বে। আমি সেটাই বলছি। যে আমাদের না আইডেন্টিটি ক্রাইসিসটা এতো বাজে। এবং আজকাল সরি, আমি আর একটু সময় নিচ্ছি। আজকাল বাংলাদেশে আমি রাস্তায় বের হয়ে, কোন ডাক্তারখানায় গিয়ে, কোন হাসপাতালে গিয়ে, যেখানে একটু বেশী লোকের সমাগম। যে একটা ওয়েটিং রুম আছে অপেক্ষা করছে। সেখানে আমি দেখি যে , একমাত্র আমি বাঙালি। আমি শাড়ি পরে গেছি। এবং আমার মাথায় ঘোমটা নাই। এবং ঘোমটা আমি খুব পছন্দ করি। আমার মা খালারা একটা পুরুষ মানুষ ঘরে এলে একটা আচল টেনে ছোট্ট একটা ঘোমটাও আছে। কিন্তু কিন্তু আজকাল যে এইটুক মুখ বের করে রাখছে, এতে তারা আর যাই হোক তারা বাঙালি নয়! তারা এই যে একটা জোরেশোরে প্রমাণ করতে চাইছে তারা বাঙালি নয়। তুমি মুসলমান ভালো কথা কিন্তু বাঙালি নয় কেন?”- মিতা হক।

 

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।