গুজব আর অপপ্রচার: রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও

12/03/2013 23:58

আবারো গুজব, আবারো অপপ্রচার, আবারো আতংকিত মানুষ! মানুষ কত সহজে আতংকিত হয় এ আবার দেখা হল! গুজবের ডালপালা কত সহজে মুখ-মুখ হয়ে মানুষের কানে কানে পৌঁছে যায় তার সর্বশেষ নজির ভিটামিন এ-প্লাস ক্যাম্পেইনে ভিটামিন এ ট্যাবলেট আর কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো পরবর্তী কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়া। সারাদেশে হঠাত করে গুজব ছড়িয়ে পড়ে এই ট্যাবলেট খেয়ে শিশু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে এবং অনেক জায়গায় নাকি অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু কোন খবরের সোর্স এবং মৃতের সংখ্যা কেউই বলতে পারেনি। যারা এই গুজবে আতংকিত হচ্ছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেও দেখা গেছে তাদের নিকটজন কেউ অসুস্থ হয়নি এবং মারাও যায়নি।

নিজের পরিবার থেকেই শুরু করে বলি, আমার ভাগনাকে আজ এই ট্যবলেট খাওয়ানো হয়েছে। এবং অনুমিতভাবেই সে সুস্থ আছে। অথচ আমার বাসার মধ্যেও এমন অনেকেই শুনেছে যে অনেক শিশু নাকি অসুস্থ হয়ে গেছে। আজ এই গুজব শোনার পর আমি আমার পরিচিত কয়েকজন ডাক্তারকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আসলেই কি এমন ঝুকি আছে? তাদের সবাইই একবাক্যে বলল- কোন ঝুকি নাই! আবার শিশু মারা যাবার কোন সম্ভাবনাও নেই।

২০১৩ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় পর্যায়ে সারা দেশের আড়াই কোটি শিশুকে ভিটামিন-এ এবং কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানো হবে বলে লক্ষ্যস্থির করা হয়। এবং ১৮ দলের ডাকা হরতাল উপেক্ষা করে মানুষ তাদের শিশুদের বিভিন্ন কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ভিটামিন-এ ট্যাবলেট ও কৃমিনাশক ওষুধ খাইয়েছে। ছয় মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিন-এ ক্যাপসুল এবং ২ থেকে পাঁচ বছর বয়সী দেশের সব শিশুকে কৃমিনাশক বড়ি এলবেনডাজল খাওয়ানো হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখের অধিক শিশুকে এ কার্যক্রমের আওতায় ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয় এই ফেইজে। এক কোটি ৬৭ লাখের অধিক শিশুকে কৃমিনাশক বড়ি খাওয়ানো হয়। ১৯৮২ সালে বছরে ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ লোক রাতকানা রোগে আক্রান্ত হতো। সেখানে বর্তমানে এই হার নেমে এসেছে শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশে। ভিটামিন -এ দৃষ্টি শক্তির উন্নতিসাধন, দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, রক্তকণিকা তৈরি করে দেহে রক্তের পরিমাণ ঠিক রাখা, ত্বকের শুষ্কতা রোধসহ সুস্বাস্থ্য রক্ষাসহ দেহের সামগ্রিক সুরক্ষায় কাজ করে। সফলভাবে ভিটামিন -এ ক্যাম্পেইন বাস্তবায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে ভিটামিন -এ'র অভাবজনিত রোগ রাতকানা ও অন্ধত্বকে প্রতিহত করতে ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে এ ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল। পরে এ ক্যাম্পেইনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। বিনামূল্যে কৃমিনাশক ট্যাবলেট প্রদানও শুরু হয়। ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল বা কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেলে সর্দি, জ্বর, কাশি, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, আমাশয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভিটামিন এ' ক্যাপসুল খাওয়ানোর পর শিশুর যেসকল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে,তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে বমি, ক্ষুধামন্দা, মাথা ঘোরানো, পেট ব্যাথা ও দূর্বলতা। ভিটামিন এ'র ক্যাম্পেইনে প্রতি বাচ্চাকে যে পরিমানের /শক্তিমাত্রার ভিটামিন-এ দেয়া হয় ,তাতে শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই ।

হঠাত করে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার কি কারণ থাকতে পারে! প্রশ্ন জাগে আমরা আমাদের শিশুদের কি সুস্থ রাখার সব প্রস্তুতি নিচ্ছিনা! যারা শিশুর অভিভাবক তারা অবশ্যই চাইছেন তাদের শিশু সুস্থ থাকুক এবং এ লক্ষ্যে তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাধ সাধছে কিছু লোক যারা খুব কৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মানুষের মাঝে আতংক সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে মরিয়া হয়ে ওঠছে। তাদের কি লাভ এখানে প্রশ্ন আসতে পারে। তবে আমরা মনে করি যারা অন্ধকারের পূজারি তারা সর্বক্ষেত্রেই নিজেদের নোংরা স্বার্থের জন্যে সামষ্টিক স্বার্থকে ব্যর্থ করে দিতে চায়- তাদের থেকে আমাদের সাবধান হবার সময় এসেছে।

জনমানুষের মাঝে আতংক সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ফেসবুক থেকেই। ফেসবুকে জামাত-শিবির পরিচালিত "বাঁশের কেল্লা" সহ সমমনা কয়েকটি পেইজ। বাঁশের কেল্লা লিখেছে-

“ভারত থেকে আমদানিকৃত ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খেয়ে বন্ধুর দুই ভাগিনা অসুস্থ। ইতিমধ্যে নোয়াখালীতে ৫০ শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।“

এরপর আর যায় কোথায়! সারাদেশে বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়ে এই গুজব। এবং মানুষজন অস্থির হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে অনেক সুস্থ শিশুকে নিয়েও অভিভাবকেরা হাজির হয়েছেন হাসপাতাল কিংবা পার্শ্ববর্তী ফার্মেসিতে। চিকিৎসকেরাও বলছেন- এ নিয়ে আতংকিত হবার কিছু নাই।

ভিটামিন-এ সম্পর্কিত এ গুজব সৃষ্টির পেছনে একটাই কারণ যারা এর হোতা তারা চায় না এই দেশের শিশুরা সুস্থ হয়ে বেঁচে ওঠুক। কারণ সুস্থ শিশুই কেবল পারে সুস্থ চিন্তার মানুষ হতে। আমরা সবাইই জানি “বাঁশের কেল্লা” ও সমমনা কয়েকটি পেইজ ইতোমধ্যেই সারা দেশে চিহ্নিত হয়ে আছে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংগঠনের জন্যে। এটা তাদের পরিকল্পনার একটা অংশ। এরা তাদেরই উত্তরসূরি যারা কিছুদিন আগে পাকিস্তানে পোলিও টিকা কর্মসূচি চলাকালে দেশটিতে গুলি করে খুন করেছিল ৬ টিকাদানকর্মী। ফলশ্রুতিতে দেশটিতে টিকাদান কর্মসূচী বন্ধ করে দেয় জাতিসংঘ। ডব্লিওএইচও-র রিপোর্টে প্রকাশ পাকিস্তানে ৩৫ লাখ শিশু এখন পোলিও ঝুঁকিতে। ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশে ভিটামিন এ ক্যাপসুল কর্মসূচি বন্ধ করতে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। ফেইসবুকে “বাঁশেরকেল্লা” ও সমমনা কিছু পেইজ বিষয়টি নিয়ে এতোটাই প্রচারণা চালাচ্ছে যাতে সহজেই বোঝা যায় এই গুজব পূর্বপরিকল্পিত।

এখন সময় এসেছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠার একটা সুন্দর পরিবেশ ও দেশ গড়তে। এর জন্যে
দরকার চিহ্নিত এই অপশক্তিকে চিরতরে নির্মূলের। এরা ঘোষণা দিয়ে দেশে "গৃহযুদ্ধ" বাধাতে চায়, এরা গুজব আর অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুন্দর ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠতে দিতে চায় না। এদের থেকে রুখতে হবে; নির্মূল করতে হবে- এ ছাড়া আর উপায় নাই!

জামাত-শিবিরের ফেসবুক পেইজ এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা এই অপপ্রচার চালানোর পর আসলে তাদেরকে ধিক্কার, নিন্দা এবং নির্মূলের কথা বলা ছাড়া আর কিছু কি বলার থাকে। তারা সত্যিকার অর্থেই যে অমানুষ তা আবার প্রমাণিত হল। একটু আগের খবর- ওসমানী মেডিকেল সড়কে মিছিল হচ্ছে- ‌নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর,' ‌‌'ভিটামিন ক্যাপসুলে বিষ কেনো, শেখ হাসিনা জবাব দে'। গুজব ছড়িয়ে মাঠে নেমে পড়েছে হায়েনারা (দেবাশীষ দেবু-ফেসবুক)

আলিম আল রাজি'র প্রাসঙ্গিক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস
 


মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছে। হাসপাতালে পা ফেলারও যায়গা নেই। মা বাবা কান্নাকাটি করছেন। - ঘটনা এ পর্যন্ত সত্য। যা শুনেছেন ভুল না। এবার পরের কাহিনীটাও শুনুন প্লিজ।

মা বাবা বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে আসছেন ঠিকই। তবে তাদের বাচ্চাগুলো একদম সুস্থ। তাহলে আসার কারণ? আর কিচ্ছু না। জাস্ট আতংক। তাঁরা কোত্থেকে শুনেছেন যে যারা আজকে ভিটামিন খেয়েছে তাঁরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।

বেশিরভাগ বাবা-মার কমপ্লেনই এরকম - 'ফোনে শুনেছি আমার ভায়রার বোনের ছোট মেয়ের আপন নাতি বিকেলে ভিটামিন এ খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। তাছাড়া লোকজনও বলাবলি করছে কীসব জানি। তাই রিস্ক না নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।'

ইন্টার্ণির ভাইয়াদের সাথে কথা বলেছি। জানালেন যে বাচ্চাদের একজনেরও ভর্তি করার মতো অবস্থা নেই। আর ১০০ টা প্যাশেন্ট আসলে এর মধ্যে তিনজনের ডায়রিয়া কিংবা জ্বর থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু না। এর সাথে ভিটামিন এ-এর কোনোই সম্পর্ক নেই।

অন্যান্য মেডিকেলের কয়েকজন বড় ভাইয়ের সাথেও কথা হয়েছে। তাঁরাও জানালেন যে ভয়ের কিচ্ছু নেই। বাবা মা শুধু আতংকিত হয়ে বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। এখন পর্যন্ত সিরিয়াস অবস্থায় একটা বাচ্চাকেও পাওয়া যায়নি। একটু দেখে টেখে তাঁরা রিলিজ দিয়ে দিচ্ছেন সবাইকে।

সুতরাং, কোনোরকম গুজবে কান দিবেন না প্লিজ।
Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।