একাত্তরের দেলু রাজাকারের নবতর সংস্করণ তেরো’র জামায়াত-শিবির

04/03/2013 16:03

আদালতের রায়ে প্রমাণিত দেলোয়ার হোসেন সাঈদী একজন যুদ্ধাপরাধী। তার বিরুদ্ধে আনীত ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এবং অপরাধের শাস্তি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। বাকি ১২টি অভিযোগ প্রমাণ না হবার অর্থ এই নয় যে তিনি সে সব অপরাধ করেন নি। প্রশিকিউশন প্রমাণ করতে পারে নি কারণ এখানে তাদের সীমাবদ্ধতা ছিল।সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখযোগ্য না হলেও উল্লেখ করছি কারণ তার মাধ্যমেই এই সব অপরাধও সংঘঠিত হয়েছিল। যার প্রমাণ সে সময়কার ভুক্তভোগী মানুষ। আদালতে প্রমাণিত না হলেও তারা সবাই জানে কুখ্যাত দেলু রাজাকার ওরফে মাওলানা দেলোয়ার হোসেইন সাঈদীর কুকীর্তি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাঈদীর বর্তমান দল জামায়াতে ইসলামী দলীয় সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী ছিল তারা। তাদের রাজাকার, আল বদর, আল শাসস নামক বাহিনী হেন কোন অপকর্ম বাকি রাখে নি যা গণহত্যার প্রভাবক। সাঈদী সে সময় জামায়াতে ইসলামীর কোন নেতা ছিলেন না কিন্তু খুব ভাল উর্দু বলতে পারেন বলে তাঁকে সব সময়ই সাথে রাখত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি লুটতরাজসহ বিবিধ অপরাধের মাধ্যমে খুব সহজেই নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তাই একাত্তরের দেলু রাজাকার একটা সময়ে হয়ে যান দেশের একজন ইসলামী বক্তা এবং পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর।

একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলা করা হয় সাঈদীর বিরুদ্ধে। এই মামলার বিচার শুরু হয় প্রথম, যুক্তি উপস্থাপনও শেষ হয় প্রথম। এটা আন্তর্যাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি)র প্রথম মামলা হলেও রায়ের দিক থেকে ৩য়। এর আগে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি (২১ জানুয়ারি ২০১৩) এবং কাদের মোল্লার (৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দিয়েছিলে ট্রাইব্যুনাল-২। ২ নভেম্বর ২০১০ তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন । সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলেছে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষকে দুই দফায় যুক্তি উপস্থাপন করতে হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অন্যান্য মামলার তুলনায় এটিতে সাক্ষীর সংখ্যাও বেশি। ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল থেকে নয় কার্যদিবসে জবানবন্দি দেন রাষ্ট্রপক্ষের শেষ সাক্ষী ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন। ৭ মে থেকে আসামিপক্ষ তাঁকে ৪৮ কার্যদিবস জেরা করে। ২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত আসামিপক্ষে ১৭ জন সাফাই সাক্ষ্য দেন। ৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু স্কাইপে বিতর্কের জের ধরে ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি নিজামুল হক সরে দাঁড়ালে ১৩ ডিসেম্বর এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। আসামিপক্ষ পুনর্বিচারের আবেদন জানায়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের পুনর্বিচারের আবেদন খারিজ করলেও দুই পক্ষকে আবার মামলার সারসংক্ষেপ ও আইনি বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। সে অনুসারে দ্বিতীয় দফায় দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ২৯ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আবার রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন। বিচারপতি নিজামুল হকের ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এক অনন্য নজির কারণ তিনি কোনভাবেই চাননি এই বিচার প্রক্রিয়া বিতর্কিত হোক।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ গঠন করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা (জেনোসাইড) ও বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন এবং তাতে সহযোগিতা করা। মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, অপহরণ, আটক রাখা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্মান্তর করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করা। যদিও সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রথমে ৩১টি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছিল কিন্তু বিজ্ঞ আদালত তার মধ্যে ২০টি অভিযোগ আমলে নেন। এই ২০টি অভিযোগ সংক্ষেপে:
অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ৪ মে। শান্তি কমিটির সদস্য হিসাবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওইদিন সকালে পিরোজপুর সদর থানার মধ্য মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে একদল মানুষের জমায়েতের খবর জানিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সেখানে নিয়ে আসে। সেখানে সাঈদী ২০অজ্ঞাতনামা নিরস্ত্র ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
অভিযোগ-২: একইদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাঈদী তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে মাছিমপুর হিন্দুপাড়া চড়াও হয়ে ঘরবাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। ভীতসন্ত্রস্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ পালাতে শুরু করলে প্রকাশ্যে তাদের উপর সাঈদীর দলবল এলোপাথাড়ি গুলি করে। যাতে খুন হন ১৩ জন। যাদের মধ্যে রয়েছে, শরত্ চন্দ্র মণ্ডল, বিজয় মিস্ত্রী, উপেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রী, মতিলাল মিস্ত্রী, যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল, সুরেশ মণ্ডলসহ আরো অজ্ঞাতনামা ৫ ব্যক্তি। যা এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ) ও ৩(২)(সি)(আই)ধারা অনুসারে মানবতার বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ-৩: ওইদিন সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মাছিমপুর হিন্দু পাড়ায় গিয়ে মনীন্দ্র পসারী ও সুরেশচন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। এরপর সাঈদী সরাসরি নিজে বিভিন্ন গ্রামে রাস্তা পাশের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে বড় ধরণের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটান। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে, কালিবাড়ি, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কালামতলা, নওয়াবপুর, আলমকুঠি, ডুকিগাথি, পারেরহাট এবং চিংড়াখালি। ধর্মীয় কারণে নিরস্ত্র মানুষের উপর এই হামলা চালানো হয়।
অভিযোগ-৪: একইদিনে পরিকল্পিতভাবে সাঈদী তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সদর থানার এলজিইডি ভবনের পেছনে ও ধোপাবাড়িরে সামনে হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলে। হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংসের জন্য তারা নির্বিচারে অজ্ঞাতনামা হিন্দু বেসামরিক মানুষের উপর গুলি করে। ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করা হয় দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালাকে। এই কাজ গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। এই গণহত্যার অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে সাঈদী আইসিটি আইনের ৩(২)(সি)(আই) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অভিযোগ-৫: স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পিরোজপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এটা জানার পর তাকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয় সাঈদী। সাঈদী ও তাঁর সহযোগী শান্তিকমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে নিয়ে ৫ মে দুপুরে সামরিক যানে করে পিরোজপুর হাসপাতাল যান, যেখানে মিজানুর রহমান লুকিয়ে ছিলেন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সাঈদীর দলে একজন চিনিয়ে দিয়ে তাকে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান। একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরে সেখানে নিয়ে আসা হয়। খুনে বাহিনীর একজন সদস্য হিসাবে সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। সাঈদী সরাসরি এই তিন ব্যক্তির অপহরণ, হত্যায় অংশ নিয়েছে, যা একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ।
অভিযোগ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল শান্তি কমিটির সদস্য পিরোজপুর সদরের পারেরহাটে গিয়ে পাকিস্তানী আর্মিকে ওই এলাকায় স্বাগত জানান। তাদেরকে পারেরহাট বাজারে নিয়ে এসে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান পাট চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে সাঈদী অন্যান্যদের সঙ্গে এ সকল বাড়ি ও দোকানে হানা দিয়ে মূল্যবান সম্পদ লুট করে। যার মধ্যে সেখানে মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্যও লুট করেন সাঈদী। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সংগঠিত এই সব কার্যক্রম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যার আইনের ৩(২)(এ) ধারায় শাস্তিযোগ্য।
অভিযোগ-৭: ৮ মে বেলা দেড়টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিয়ে সদর থানার ভাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে হানা দেন। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে তিনি তাকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। যারা তাকে নির্যাতন করে। বাড়ি লুটপাট করার পর যাওয়ার পূর্বে আগুন লাগিয়ে বাড়িটাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এটা আইনের ৩(২)(এ) এবং ৩(২)(জি) ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগ-৮: একইদিন বেলা ৩টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তার সাঙ্গপাঙ্গরা পাক বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহিমকে সহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যান। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। সেনা ক্যাম্পে ফেরার পথে সাঈদীর প্ররোচণায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে লাশ ব্রিজের কাছে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে সাঈদী ও অন্যদের আগুনে পারের হাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাঈদী সরাসরি অপহরণ, খুন, যন্ত্রণদানের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। যার আইনের ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে অপরাধ।
অভিযোগ-৯ : ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল নয়টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইন্দুরকানি থানার নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে হানা দিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট এবং বাড়ি আগুনে ছাই করে দেয়। এটা ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।
অভিযোগ-১০: একইদিন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যার মধ্যে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল মণ্ডল, বিসাবালি, সুকাবালি, সতিশবালা। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসাবালীকে নারকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। বেসামরিক মানুষের বসবাসের বাড়িতে আগুন দেয়া নিপীড়নের শামিল। সাঈদী বাড়িঘর পোড়ানো, বিসাবালিকে হত্যা মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছেন। যা ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।
অভিযোগ-১১ : ২ জুন সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ইন্দুরকানি থানার টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে সাঈদী তাঁর বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করে। এরপর সাঈদী নগদ টাকা, অলঙ্কারাদি ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান।
অভিযোগ-১২: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের হিন্দুপাড়ায় গিয়ে ১৪ জন হিন্দুকে ধরে এক দড়িতে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে হস্তান্তর করে। পরে তাদেরকে হত্যা করে লাল নদীতে ফেল দেয়া হয়।
অভিযোগ-১৩: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর এক রাতে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সদর থানার নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয়। পরে সাহেব আলীকে অপহরণ করে সাঈদী, যার লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে।
অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এক সকারে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী সদর থানার হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে শেফালী ঘরামি ও মধুসুদন ঘরামি ছাড়া বাকিরা সবাই পালিয়ে যায়। তখন রাজাকার বাহিনীর কিছু সদস্য শেফালী ঘরামির ঘরে দিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। দলনেতা হওয়া সত্ত্বেও সাঈদী এই ধর্ষণে বাধা দেননি। পরে তারা এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দিয়ে দেয়।
অভিযোগ-১৫: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের তরণী শিকদার, নির্মল শিকদার, শ্যামকান্ত শিকদার, বাণীকান্ত শিকদার, হরলাল শিকদার, প্রকাশ শিকদারসহ ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে নিয়ে যায়। এদেরকে তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, যারা এদেরকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
অভিযোগ-১৬: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তাঁর তিন বোনকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাদেরকে আটকে রেখে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে ছেড়ে দেয়।
অভিযোগ-১৭: সাঈদী ও তাঁর নেতৃত্বের সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপ্লব সাহার মেয়েকে তাঁর বাড়িতে আটকে রাখে। তারা ওই বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত তাকে ধর্ষণ করত।
অভিযোগ-১৮: ভাগিরথি নামে এক নারী পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে কাজ করতেন। পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেওয়ার অভিযোগে সাঈদী তাকেও আটক করে নির্যাতন করেন। পরে তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
অভিযোগ-১৯: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে “স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সাঈদী জোর করে মধুসুদন ঘরামী,কৃষ্ট সাহা,ডা. গণেশ সাহা,অজিত কুমার শীল,বিপদ সাহা,নারায়ণ সাহা,গৌরাঙ্গ পাল,সুনীল পাল,নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস,গৌরাঙ্গ সাহা,হরিদাস,গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া,অন্যরাণী ও কামাল রাণীসহ ১০০/১৫০ জন হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেন।
অভিযোগ ২০: নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সাঈদী সংবাদ পান যে,হাজার খানেক মানুষ জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে। এরমধ্য কোনো একদিন সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে হামলা করে ৮৫ ব্যক্তিকে আটক করেন সেখানে ব্যাপক লুটপাট চালায়। পরে আটককৃতদের নিয়ে আসা হয় স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে। সেখান থেকে ফজলুল হক নামে এক রাজাকারের মধ্যস্থতায় ঘুষের বিনিময়ে ১০-১২ জন ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে আটক পুরুষদের নির্যাতন এবং খগেন্দ্রনাথ সাহার মেয়ে দীপালি,স্ত্রী নিভারাণী,রাজবল্লভ সাহার মেয়ে মায়ারাণীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়,যারা ক্যাম্পে ধর্ষণের শিকার হন।
এই অভিযোগগুলোর মধ্যে আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায় বলে বিজ্ঞ আদালত সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। প্রমাণিত আটটি অভিযোগ হচ্ছে ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগ। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই অন্যগুলোতে আলাদা করে কোনো শাস্তি নির্ধারণ করা হয়নি।
১২০ পৃষ্ঠার রায়ের শুরুতেই বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর বলেন, আমরা রায়ের আগে দুটি কথা বলতে চাই। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরিচয় দেওয়ার কোনো দরকার নাই। ওনার ওয়াজ শোনার জন্য হাজার মানুষ যান। উনি শুধু প্রখ্যাত মাওলানা নন,উনি দুবারের এমপি। জামায়াতের নায়েবে আমির। কিন্তু আমরা তাঁকে নায়েবে আমির কিংবা সাংসদ হিসেবে বিচার করছি না। আমাদের ফিরে যেতে হবে ৪০ বছর আগে। তখন তিনি ৩০ বছরের যুবক ছিলেন। তিনি ছিলেন বিবাহিত,এক সন্তানের জনক। পিরোজপুরে সাউদখালীতে বাড়ি। তখন তিনি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পিরোজপুরের শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আলেম পাস। উর্দুতে ভালো কথা বলতে পারতেন। তাই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাঁর ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়। আমাদের বিচার করতে হবে,তিনি সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। আমরা সেই ৩০ বছরের যুবকের বিচার করছি;বর্তমানের সাঈদীর বিচার করছি না, যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে গ্রামের নিরীহ লোক ও সাধারণ মানুষ।  বিচারপতির এই বক্তব্য বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে এই কারণে যে, সম্পূর্ন ব্যক্তিক চিন্তা এবং পারিপার্শ্বিকতার বাইরে উঠতে পেরেছিলেন তিনি- যা তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার!
একাত্তরে সাঈদী ওরফে দেলু রাজাকার মানবতাবিরোধি বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত ছিলেন। তার ফাঁসির আদেশের পর তার দল জামায়াত-শিবির সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। প্রকাশ্যে সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষ হত্যা, রাষ্ট্রীয় এবং সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতিসহ লংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে। জামাত-শিবিরের এই সন্ত্রাস তাদের নেতা দেলু রাজাকার ওরফে মাওলানা সাঈদীর একাত্তরের ভূমিকার যেন পরিবর্তিত সংস্করণ। একাত্তরের যেখানে ছিল শান্তি কমিটি আর ২০১৩ সালে এসে তার ভূমিকায় জামায়াত-শিবির। নাম ভিন্ন হলেও ভূমিকাটা একই!
সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রথম দিনেই সারাদেশে অর্ধশতাধিক লোক নিহত হয়েছে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের কারণে। এরপর থেকে এই সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে হামলা ও সন্ত্রাসের সংখ্যা। জামায়াত-শিবিরের অব্যাহত সন্ত্রাস তাদের একাত্তরের ভূমিকাকে মনে করিয়ে দেয় যা আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মক্তিযোদ্ধার মুখে শুনেছি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া, হত্যা হুমকি সব কিছু করছে তারা ধর্মের নাম মুখে নিয়ে। অথচ তাদের মুখের যে ইসলাম তা কোনক্রমেই এরকম সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের অনেক ওলামা-মাশায়েখ জামাত-শিবিরের মুখের বুলি ইসলামকে ইসলাম বলে মানতে নারাজ। তাদের কাছে জামায়াত-শিবির কোন ইসলামী দল নয়।
জামায়াত-শিবির যারা মুখে ইসলামের কথা বলছে তারা সাঈদীর ফাঁসির রায় হবার পর তাকে আল্লাহর সাথে তুলনা করে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ১৬০ টি আসনে জয় লাভ করে । আর যে দুটি আসনে জয় লাভ করতে পারে নাই তার মধ্যে একটি হল জামাতের আঁখড়া সাতকানিয়া-বাঁশখালী । এই আসনটি তখনো পশ্চিম পাকিস্তানী ভুট্রোর পিপলস পার্টি জিতে নেয়। সেই থেকে এখন অব্দি এই সাতকানিয়া হল জামাত-শিবির উৎপাদন ক্ষেত্র। পুরো বাংলাদেশের মধ্যে এটি শুধু জামাতের ঘাঁটি না বলতে হয় সামরিক ক্যান্টনমেন্ট । জামাতের সব ধরনের অপকর্মের নীল নকশা করা হয় এখান থেকেই। দেলু রাজাকারের রায় ঘোষনার পর থেকে এই সাতকানিয়া এখন কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে । জামাতি সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তাই প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে । রাস্তা ঘাটে অসংখ্য জ্যান্ত গাছ কেটে ফেলে রেখে পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে । সেই সুযোগে জামাতি সসস্ত্র ক্যাডাররা ভিন্নধর্মালম্বী ও প্রগতিশীল লোকদের বাড়িতে ডাকাতি, লুটপাত ও অগ্নি সংযোগ করছে । তারা বিভিন্ন মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও প্রতিমা ভাংচুর করছে। সেখানে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ জামায়াত-শিবির করে জন্মাবার পর থেকেই। সাতকানিয়ার অনেক মাদ্রাসায় সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর এবং তাদের সন্ত্রাসের পর পাকিস্তানি পতাকা ওড়াচ্ছে। বগুড়াসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়েছে রাত সাড়ে তিনটার সময়ে চাঁদের বুকে সাঈদির ছবি দেখা যাবে। এবং কিছু ধর্মান্ধ লোকজন তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে শেষ রাতে খোলা জায়গায় এসে হাজির হয়েছে এবং তারা পরের দিনই বিভিন্ন জায়গায় হামলা করেছে। (সূত্র:টিভি চ্যানেল ও প্রথম আলো ০৩-০৩-২০১৩) মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কিভাবে বিপথে চালিত করা যায় এটা অভিনব এবং ন্যাকারজনক এক নিদর্শন। এর চাইতেও বড় আশ্চর্যের বিষয় এই চাঁদে দেখার বিষয় যারা প্রচার চালাচ্ছে তাদের অনেকেই কলেজ-ভার্সিটির স্টুডেন্ট! মানুষ কতখানি লজ্জাহীন আর অন্ধ হতে পারে এটা তার একটা প্রমাণ। যদিও অনেককেই বলতে শুনি যারা জামায়াত-শিবির করে তারা নাকি মানুষই না! জামায়াত-শিবির মানুষ নয় তারা জামাত-শিবির! তাদেরকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়ন করার প্রয়োজন নাই।

সাঈদীর ফাঁসির রায় আদালতের বিষয়। আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে একাত্তরের সেই দেলু রাজাকার বর্তমানের মাওলানা দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী। তার এলাকা পিরোজপুরের মানুষ জানে কতটা নির্মম ছিল সে একাত্তরে। তাই ফাঁসির রায় হবার পর জনমানুষ নেমে এসেছে সারাদেশের মত পিরোজপুরেও। জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে আমাদের আদালত।

বাংলাদেশ আস্তে আস্তে ইতিহাসের দায় মেটাচ্ছে। আমাদের কলঙ্কমুক্তি হচ্ছে ক্রমশ। রায় পরবর্তী জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস, হামলা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের পরও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধিমুক্ত বাংলাদেশের দিকেই এগুচ্ছি এটাই এই ইতিবাচক দিক।

তথ্যসূত্র: পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেল।

================================================================================

বিভীষিকাময় এবং বর্ণচোরা চরিত্র সাঈদী যেভাবে নিজেকে পাল্টেছেন সময়ে সময়ে:

যুদ্ধাপরাধী রাজাকার দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী সময়ে সময়ে নিজেকে আড়াল করেছে নাম-পরিচয় এবং অবস্থান পরিবর্তন করে। একাত্তরের দেলু ওরফে দেইল্যা রাজাকার এক সময় নিজের নামের আগে "আল্লামা" এবং "মাওলানা" সংযুক্ত করে। তবু এক সময়ে তার চেহারা প্রকাশ হয়েছে মানুষের কাছে।

তাবিজ বিক্রেতা থেকে রাজাকার কমান্ডার :
যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধি অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড পাবার সময় পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুর জেলার তৎকালীন ইন্দুরকানীর (বর্তমানে জিয়ানগর উপজেলা) সাউথখালী গ্রামে ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম ইউসুফ আলী শিকদার। সাঈদীর প্রকৃত নাম দেলোয়ার হোসেন শিকদার। তাকে দেলু অথবা দেইল্যা নামে এলাকার সবাই চিনতেন। মওদুদীবাদী জামাতের ছাত্র রাজনীতি করার কারণে সাঈদী শর্ষিনা মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর বারইপাড়া মাদ্রাসা থেকে তৃতীয় বিভাগে আলিম পাস করেন। মাদ্রাসা থেকে তারপর কোন প্রকার উচ্চতর ডিগ্রি না নিলেও নামের সঙ্গে ‘আল্লামা’ টাইটেল ব্যবহার করা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন সাঈদী। সংসার চালানোর জন্য পারেরহাটে তার একটি ছোট মুদি দোকান থাকলেও তিনি মূলত তাবিজ বিক্রি করতেন।
জানা যায়, সাঈদী ছিলেন উর্দু ভাষায় পারদর্শী। এ কারণেই খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। যার সূত্র ধরে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হতে সক্ষম হন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই সে ছিলো শান্তিকমিটির সদস্যও। তার নেতৃত্বে এবং তার সহযোগিতায় পিরোজপুরের পারেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুট, সম্ভ্রমহরণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে।

যেভাবে আল্লামা সাঈদী
আন্তর্যাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনীত রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, সাঈদীর আসল নাম দেলোয়ার হোসেন শিকদার। একাত্তরের আগে তিনি পিরোজপুরে এ নামেই পরিচিত ছিলো। লোকে তাকে প্রথমে ‘দেইল্যা’ বা দেলু এবং মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধের জন্য ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামেও চিনতেন। স্বাধীনতার পর একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর তিনি নিজের অপরাধকে আড়াল করার জন্য বোরকা পরে গরুর গাড়িতে চড়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে অস্ত্রসহ যশোরের রওশন আলীর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। অনেকদিন পর তার অপরাধের কাহিনী জানাজানি হলে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তিনি আত্মগোপন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসেন এবং মাওলানা পরিচয়ে ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন। নিজের নাম পাল্টে করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এভাবেই সে ‘আল্লামা’ ‘মাওলানা’র পরিচয়ে নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করে।

যেভাবে আলীম পাস এবং বয়স
নিজেকে ‘আল্লামা’ ‘মাওলানা’ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী প্রমাণে এই যুদ্ধাপরাধী দাখিল পাসের সনদপত্র জালিয়াতি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। দাখিলের সনদপত্রে তার নাম ছিল মোস্তফা দেলাওয়ার হোসাইন। আলিমের সনদপত্রে সেটা হয়ে যায় আবু নাঈম দেলাওয়ার হোসাইন। আগের দাখিল সনদপত্র অনুযায়ী সাঈদীর জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩ মার্চ। আর সেখানে তার দাখিল পাসের বছর দেখানো হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। সে হিসেবে সে দাখিল পাস করেন মাত্র ১০ বছর বয়সে! জালিয়াতির মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। অন্যদিকে সনদপত্রে ঘষামাজা করে দাখিলে তার বয়স করা হয় ১৬ বছর। আলিমে ১৯ বছর করা হয়।
জানা গেছে, সাঈদীর দাখিল ও আলিম পরীক্ষা পাসের সনদপত্র ও জন্ম তারিখ সংশোধন করা হয়েছে কথিত পরীক্ষার যথাক্রমে ৪৮ ও ৫১ বছর পর। উল্লেখ্য, পাবলিক পরীক্ষার আইন অনুযায়ী পাস করার দুই বছরের মধ্যে একজন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর বয়স সংশোধন করা যায়। কিন্তু দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নাম ও বয়স পাল্টেছিলেন পাস করার ৫১ বছর পর।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় মনোনয়নপত্রে এসব অসঙ্গতি ধরা পড়তে পারে তা বুঝতে পেরে ওই বছরের ১০ নভেম্বর মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে মাদরাসা বোর্ড থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে নাম ও বয়স পরিবর্তন করে সংশোধিত সনদপত্র বের করে আনা হয়। এ দুর্নীতি ও সনদ জালিয়াতির সঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ডের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই তিনি আদৌ দাখিল পাস করেছে কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্বঘোষিত এই “আল্লামা” পরীক্ষা না দিয়েই সরকারি নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা তৎকালীন মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে ১০ বছর বয়সে দাখিল পাসের সনদপত্র বের করে এনেছেন। ২০১২ সালের ১২ আগস্ট সাঈদীর নাম ও বয়স পাল্টানোর অভিযোগের তদন্ত করতে একটি উপ-কমিটি গঠন করে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। কমিটির সদস্য আব্দুল ওহাবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। এ উপ-কমিটি দীর্ঘ তদন্ত করে সাঈদীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে স্থায়ী কমিটির কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে গত ২১ জানুয়ারি ২০১৩তে.।
এভাবেই সময়ে সময়ে দেলু/দেইল্যা থেকে সাঈদী হয়ে মাওলানা/আল্লামা হিসেবে প্রতিষ্টিত হতে চেয়েছেন প্রমাণিত এই রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী।

 

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।