অপশব্দ গোলাম আযম একাত্তরের গণহত্যার সারাংশ

02/06/2013 08:24

রাজাকার শব্দের অর্থ এবং তাদের কার্যকলাপ জানার আগেই চিনেছিলাম গোলাম আযমকে। নামটা ভয়ংকর এক অশনিসংকেত হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। যখন নিজের নাম ঠিকানা ভাল ভাবেই লিখতে এবং বলতেও জানতাম না তখনো ছিল এই নাম। এরপর আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা এবং পরবর্তী সময়ে পরিচয়! গোলাম আযম আর রাজাকার এই শব্দ দু’টি সত্যিকার অর্থেই আতংক জাগানিয়া নাম।

খুব ছোটবেলাকার কাহিনী, গ্রামে থাকতেই গোলাম আযমের সাথে পরিচয়! চেহারা দেখিনি তখনও! গ্রামের পাশ দিয়েই সড়ক ও জনপথের বড় রাস্তা। সেখান দিয়ে অনেক অনেক গাড়ির আসা-যাওয়া। রাস্তা পার হতে গিয়ে খুব সাবধানী হতে হত। ছোট-বড় অনেক গাড়ি,হর্ণ,সাই-সাই ছুটে যাওয়া।

তখনো একা একা বড় রাস্তার আশপাশে যেতাম না। পরিবারের কড়া নিষেধ ছিল। নিষেধ অমান্য করলে বেতের বাড়ি! বিকেলে তবু একটু ফুরসৎ আর স্বাধীনতা! পারিবারিক বিধিনিষেধের খানিক ছাড় তাই সুযোগ হত একটু-আধটু! ক্রিকেট-ফুটবল মাথা-মগজে তাই রাস্তা পার না হয়ে মাঠে যাওয়া সম্ভব ছিল না! পাকা রাস্তা মানে বাস-ট্রাক আর গাড়ির বহর! বড় বড় ট্রাকের উদ্দাম গতি দেখে খুব ভয় পেতাম। আমাদের চাইতে বয়সে বড়রা ট্রাক দেখলে ঝাপটে ধরে আটকে দিয়ে বলতেন- সাবধান,সাবধান গোলাম আযম; গোলাম আযম আসছে! তাদের কাছে ট্রাক মানে গোলাম আযম!  সেই থেকে শৈশব মনোজগতে গোলাম আযম মানে আতঙ্কের নাম এবং প্রাণসংহারি কিছু!

আমাদের ছোটবেলায় গোলাম আযম ছিল এভাবে! বড় হয়ে তাকে জেনেছি অন্য এবং তারচেয়ে ভয়ংকরভাবে। এক সময় গ্রাম থেকে শহরে আসলে তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ হল! প্রথম দর্শনে মনে হয় চেহারার মাঝে চাপা এক হিংস্রতার ছাপ! হয়ত খুনে স্বভাব চেহারার মাঝে পরিস্ফুট হয়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক নিয়মেই। অথচ শাদা চুল-দাড়িমার্কা এমন চেহারায় অন্য যে কোন স্বাভাবিক মানুষ দেখলে অপ্রকাশ্য শ্রদ্ধা চলে আসারই কথা ছিল। কিন্তু কি অদ্ভুত নিয়তি, চেহারা যে মানুষের মন আর চরিত্রের প্রতিবিম্ব হয়ে এভাবে ধরা দেবে ভাবিনি আগে কোনদিনও!

আমাদের শৈশব-কৈশোরের গোলাম আযম কাহিনী ছিল এমনই! বড়বেলায় এসে জানা হলো, মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী,পরিকল্পনাকারী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী রাজাকার,আলবদর,আলশামস গঠনের মূল হোতা ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক এই গোলাম আযম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। তার পরিকল্পনায় ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা হয় বাংলাদেশে। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ এবং দুই লক্ষ নারীর অপমানের প্রধান পরিকল্পনাকারী পরাজয় আঁচ করতে পেরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। সেনাশাসক মেজর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে তিন মাসের ভিসায় বাংলাদেশে আসেন তার অসুস্থ মা’কে দেখতে আসার নাম করে। ভিসা তিন মাসের জন্যে নিলেও এরপর আর ফেরেননি তিনি। উল্টো বিভিন্নভাবে জেঁকে বসেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে! এরপরের ১৯৯২ সালে যখন জামায়াতে ইসলামি তাদের ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ থেকে রাজাকার আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে দিয়ে গোলাম আজমকে ‘আমীর’ ঘোষণা করলো তখন চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সামনে চলে আসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদণ্ডতূল্য বলে ঘোষণা করলেন। এই আদালত ছিল প্রতীকী কিন্তু এর জাগরণ ছিল সত্যিকার অর্থেই বাস্তবিক।

একাত্তরের গণহত্যার প্রধানতম পরিকল্পনাকারী জামায়াতে ইসলামের সাবেক আমীর এবং তাদের আধ্যাত্মিক নেতা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের রায় দেবে আইসিটি ট্রাইব্যুনাল-১। ১৭ এপ্রিল ২০১৩ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এখন চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত তার হাত আর মাথায় জড়িয়ে! বয়সের ভারে ন্ব্যুজ এই অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে মাত্র পাঁচটি! তদন্ত সংস্থা ২০১০ সালের ১ আগস্ট তদন্ত শুরু করে। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলি ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করলেও তা সুবিন্যস্ত ও গোছালো না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ ফেরত দেন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ পুনরায় দাখিল করলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নিয়ে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে হাজির হতে বলেন। সে অনুযায়ী গ্রেফতার হওয়া গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার পক্ষ থেকে জামিনের আবেদন হয় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই জামিন নামঞ্জুর হয়ে শুরু হয় বিচারকার্য!

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমলে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও এর অনুরূপ আন্তর্জাতিক অপরাধের ষড়যন্ত্র,পরিকল্পনা,উস্কানি,সহযোগিতা এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। প্রথম অভিযোগের মধ্যে আছে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনে ষড়যন্ত্র। এই অভিযোগে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, ৪ এপ্রিল ১৯৭১ গোলাম আযম,নুরুল আমীন,মৌলভী ফরিদ আহমেদ,খাজা খয়েরউদ্দিন,এ কে এম শফিকুল ইসলাম,মাওলান নুরুজ্জামান,হামিদুল হক চৌধুরী,মোহসিনউদ্দিন আহমেদ,এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করে। এর ধারাবাহিকতায় রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে  বৈঠকের রাজাকার (রেজাকার) বাহিনী গঠনের পরামর্শ দান। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনী গঠন এবং গণহত্যায় সহযোগিতা!

দ্বিতীয় অভিযোগে রয়েছে পরিকল্পনা। টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল ১৯৭১ গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। তৃতীয় অভিযোগে রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি। যেখানে ২৮টি ঘটনা উল্লেখ আছে।

চতুর্থ অভিযোগে রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা এবং সম্পৃক্ততা। যেখানে ঘটনার উল্লেখ আছে ২২টি। যার মধ্যে ৪ ও ৬ এপ্রিল ১৯৭১ টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার,আলবদর,আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করে যা পরবর্তীতে গণহত্যা সংগঠনে ভূমিকা রাখে।

পঞ্চম এবং সর্বশেষ অভিযোগে রয়েছে হত্যা ও নির্যাতন। যেখানে রয়েছে ঘটনার উল্লেখ। কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধকালে ছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর)। সিরু মিয়া সে সময় পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থাকলেও ২৮ মার্চ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন। ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ কসবা থানা চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে তাদের ওপর চলে নির্যাতন। স্বামী-সন্তানের এমন অবস্থায় সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোলাম আযম সিরু মিয়ার স্ত্রীর স্বামী-ছেলের প্রাণ বাঁচানোর আকুতির প্রত্যুত্তরে  ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে  চিঠি পাঠিয়ে উল্টো তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাবার পর পাকিস্তানি সেনারা পিরু মিয়াসহ ৩৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

রাজাকারকুল শিরোমণি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাত্র পাঁচটি অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে। এই পাঁচ অভিযোগ আসলে সংখ্যাগত দিক দিয়ে তেমন কিছু মনে না হলেও অপরাধের ভয়াবহতা এবং পরিকল্পনার আলোকে বলা যায় এই অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে একাত্তরের গণহত্যার সারমর্ম। জামায়াতে ইসলামের মূখপত্র তৎকালীন সংগ্রাম পত্রিকাই তার কীত্তিকলাপের অন্যতম সাক্ষ্য নির্দেশ করে।  নিজেদের পত্রিকা ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় এভাবে যে অপরাধের সাক্ষী হয়ে যাবে তা তারা হয়ত ভাবেনি আগে!

এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। পাঁচ অভিযোগে মাত্র পাঁচবার ফাঁসি নয় ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ নারীর অপমান কি শাস্তির বিনিময়ে তাকে প্রতিদান হিসেবে দেয়া যায় তা যদি আইন-আদালত ব্যতিরেকে কারো কাছ থেকে শোনার সুযোগ থাকত তবে অতি অবশ্যম্ভাবী হিসেবে বলা হত একই সাথে ত্রিশ লক্ষ বেয়নেট তার শরীর দিয়ে ঢুকিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়া! তবেই সম্ভবত কিছুটা হলেও  শাস্তির ব্যবস্থা হত। কিন্তু যেহেতু সেটা সম্ভব নয় তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সবার দাবি সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর। এখানে বয়সের বিষয়টি বিবেচনায় নেবার সুযোগ নাই কারণ সর্বোচ্চ অপরাধির শাস্তি সর্বোচ্চ না হলে আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা প্রকট হয়ে যেতেও পারে!

গোলাম আযম রাজাকার আর নৃশংসতার প্রতিশব্দ। আমাদের শৈশব আর কৈশোরের ভয়াবহতার রূপক নাম। জাতি মুক্তি চায় এই অপশব্দ থেকে। তাই প্রিয় স্বদেশ,আমার শৈশবের সেই ট্রাকগুলোকে অপবাদ থেকে চিরমুক্তি দাও,আর যেন কখনো ট্রাক দেখে না বলতে হয়- ঐ আসছে গোলাম আযম!

 

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।