দৃশ্যের অন্তরালে দৃশ্যহাট

 

আর একটু পথ পাড়ি দিলে আমি পেয়ে যাবো তোমার বাড়ি যাবার পথ। এই পথ কোন এক অলুক্ষণে পথ। যে পথের শুরু আছে কিন্তু শেষটা অজানাই। এই পথ, সেই পথ, কত পথ কত পথ যে এভাবে পাড়ি দিলাম তার হিসেব রাখিনি বলে আমার নিয়ত পথচলা। পথের বাঁকে বাঁকে এসে পথ খুজি, পথ দেখি অথচ প্রকৃত পথের সন্ধান কোথা সে আমার যেমন অজানা ঠিক তেমনিভাবে আর সব পথচলতি পথিকেরও।
 
 
মনে পড়ে সেদিন কোন এক বিকেলে বিকেল নেমেছিল পৃথিবীতে। তোমার সাথে আমার দেখা হবার নির্ধারিত সময়। আমি মোটরসাইকেল করে এসেছিলাম আর তুমি এসেছিলে বাসে করে। বাসকে তুমি ‘বাচ’ বলো। এটা আঞ্চলিকতার প্রভাব হতে পারে। এ নিয়ে তোমার সাথে আমার কত যে খুনসুটি! আমি আমার প্রেমিকা নিয়ে কোনদিন কারো সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইনি বলে আজ এ পর্যন্ত বারবার তোমাকে সতর্ক করেছিলাম কিন্তু তুমি তা মানার কোন গরজই দেখাওনি। কেন কী হয় তোমার একটু-আধটু প্রমিত বাংলায় কথা বললে। অথচ তোমার এক কথা এই শহর ঢাকা শহর, এখানে মানুষ দিনকে দিন যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। এই তুমিও যন্ত্র হয়ে যাচ্ছো। কথা বলছো শুদ্ধ বাংলায়। তোমারও অনেক উচ্চারণগত ভুল আছে। কই তুমি কী আর আটকে গেছো জীবন চলার পথে। আমি কী আর তোমার সাথে প্রেম করতে যাবার আগে তোমার ভাষা সম্পর্কিত কোন ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। আমি তখন আর বলিনা কিছু। সত্যই তো। মিথ্যে কিছু বলেনি অদিতি। এতটুকু বলে নিজের ভাষায় নিজের মতো করে বলে থামলো হাসান। মনে হচ্ছিল ওকে সামনে রেখেই বলছিল সে।
 
এরই ফাঁকে পরিচয় করিয়ে দিই। গল্পের নায়িকা অদিতির সাথে হাসানের প্রেমের বয়স মাত্র মাস চার। এরই মাঝে ওরা এগিয়েছে অনেকদূর। এই সমাজ-বাস্তবতাকে ওরা ভালোই রপ্ত করা শিখে গেছে। আধুনিক প্রেম। অত্যাধুনিক জীবনাচরণ। হাসানের নিজের একটা মোটরসাইকেলও আছে। অদিতির সাথে প্রেম হবার ঠিক আগে কিনেছে। নিজের ইচ্ছেয় কিনেনি সে। বন্ধু-বান্ধবদের উৎসাহেই কিনেছে সে। হাসানের এক বন্ধু বলেছিল মেয়েরা না-কি মোটরসাইকেলওয়ালা ছেলেদের সাথে প্রেম করে। সেই থেকে আগ্রহ আর কেনা। তারপর আশ্চর্যজনকভাবে প্রেম। অবশ্য দোকানিকে পূরো টাকাটা দিতে পারেনি সে। কিস্তিতে কেনা। মাসে মাসে শোধ দিতে হয়। 
 
অদিতির আবার ভিন্ন ভিন্ন শখ। শুক্কুরবারে সে মার্কেটে যাবেই। ঐ সন্ধ্যায় চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। স্যুপ, অনথন। শনিবারে শপিং। মোটামোটী নিয়মিতই। হাসান সব শখ মিটিয়ে চলে। নিজে ভালো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো বেতনে আছে। এছাড়াও পরিবারের ভালোই সার্পোট পায় সে মাঝে মাঝেই। বড় ভাই দেশে ব্যবসা করে। বাপের টাকা-পয়সা নেহায়েত কম না। ভাবছেন তাহলে কিস্তিতে বাইক কিনলো কেন? সেটাই রহস্য বলে মানছি। আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন একদিন। বলেনি কিছু, মুচকি হাসি দেয়া ছাড়া। 
 
হাসান আর আমি আগে একসাথে থাকতাম। এখন আর থাকি না। আমাকে মোটামোটি বের করেই দিয়েছে কৌশলে। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি তা। আমি যথেষ্ট বুঝি আজকাল। তাই নেপথ্যের কাহিনী ভেবে মনে মনে হাসি। অসহায়ের শুকনো হাসি। অদিতির প্রতি আমারও কেমন জানি আকর্ষণ কাজ করছে আজকাল। ওকে দূর থেকে দেখলে তাকিয়ে থাকি। ওর মোবাইল নাম্বার আমার কাছে আছে। একটা ছবিও আছে। অবশ্য চুরি করে আনা। বাসা ছাড়ার সময় হাসানের ড্রয়ার থেকে তাকে না বলে নিয়ে এসেছিলাম। দারুণ ছবি। কী মিষ্টি হাসি। সুঠাম ফিগার। অপলক চাহনি। আমি প্রতিরাতে একা একা তাকে দেখি। কথা বলি তার সাথে একতরফা। কোন উত্তর দেয়না সে। শুধু শুধু তাকিয়ে থাকে। বোবা মেয়ে কোথাকার! ছবি হয়েছো বলে কী কথা বলতে হয়না! কী এমন ক্ষতি হয় এতোটুকু কথা বললে!
 
ইদানিং আমার মাঝে হাসানের প্রতি কেমন যেন হিংসা জন্মে গেছে। ওর মোটরসাইকেল আছে আমার থাকতে হবে তার চেয়ে বেশি কিছু। নিদেনপক্ষে একটা সিএনজি। আরে দূর! কী ভাবছি এসব! সিএনজি থাকলে কী আর অদিতি আমাকে পাত্তা দেবে? তাই শেষমেষ বড়ভাইয়ের টাকায় একটা প্রাইভেট কার কিনে ফেললাম। হাসানকে টেক্কা দেয়া আমার চাই-ই চাই। আমি প্রতিরাতে রুটিন করে অদিতিকে দেখি। মোবাইলের বাটনগুলো টিপি কিন্তু কল করা আর হয়না। ভয় অথবা সঙ্কোচে!
 
আদিতি আর হাসান আমার গাড়ি কেনার খবর পেয়ে গেছে। সেদিন কায়দা করে আমি ওদের চোখের সামনে দিয়ে ড্রাইভ করে গিয়েছিলাম। একনিমিষে আমি ওদের চোখের ভাষা পড়ারও চেষ্ঠা করেছি। আমি এক্ষেত্রে যে সফল হয়েছি তা বলে দেয়া যায়। তবু মনে মনে খিঁচ-মিচ করে আমার সফলতার জায়গা যে অন্য কোথাও। সে অদিতি, অতি অবশ্যই অদিতি। হোক না সে বন্ধুর প্রেমিকা। বউ তো না!
 
আজকাল কোথাও দেখা হয়ে গেলে অদিতি দেখছি আমার দিকে অন্যভাবে তাকায়। আমার চোখ তাকে দেখে চোখের অপলক ভাষা দিয়ে। আমি কিছু বলতে পারিনা। শুধু শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া। আমি প্রতিরাতে তাকে দেখি। জেগে ওঠলে তাকে দেখতে চাই। কিন্তু সে আসেনা আমার জাগরণের কালে। শুধু ছবি হয়ে থাকে। আমি তার সাথে কথা বলে বলি। চিমটি কাটি; প্রতুত্ত্যরবিহীন। 
 
গতরাতে প্রতিদিনের মতোই অদিতি এসেছিল। ঘুম ভেঙ্গে দেখি নেই। আমি তাকে খুঁজি হন্যে হয়ে। নাই, নাই, কোথাও নাই! চোখ আটকে যায় মোবাইল স্কিনে! তড়িতাহতের মতো বসে পড়ি!
 
এককালের কাছের বন্ধু হাসানের অসহায় মুখ জ্বলজ্বল ভাসে।
 

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।