GSP সুবিধা স্থগিত: ক্ষতি সাময়িকভাবে আর্থিক নয়, তবুও আশংকা

29/06/2013 02:44

জেনারেলাইজড সিস্টেমস অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) এর আওতায় গত বছর আমেরিকায় রপ্তানি করা পণ্যের তালিকার মধ্যে ছিল তামাক, প্লাস্টিক-প্লাস্টিকজাত পণ্য, চীনামাটির পণ্য ও খেলা সামগ্রী। এর সবগুলো বাংলাদেশের তৈরি করে না। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি জানানোর পরও আমেরিকায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় নি। আমেরিকার GSP স্থগিত আর্থিকভাবে যতটা না প্রভাব পড়বে তারচেয়ে বেশি ভাবমূর্তিতে!  কারণ আমেরিকা সারাবিশ্বের প্রভাবক এক শক্তি!

জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ হাজার পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করতে পারে। প্রতি বছর আমেরিকায় রপ্তানি করা পণ্যের মাত্র এক শতাংশ GSP'র আওতাভুক্ত ছিল। যা প্রায় পাঁচশ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের খুব ছোট্ট একটা অংশ বটে। কারণ আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধার আওতায় না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। ইইউভুক্ত দেশসমূহে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত জিএসপি সুবিধা পেয়ে থাকে। আমেরিকা সরাসরি সব জায়গায় তার হাত-কালোহাত বিস্তার না করলেও পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ আমেরিকায় বৃষ্টি হলে তারা নিজ নিজ শহরে ছাতা ধরে বলে প্রমাণিত। আমেরিকার এই জিএসপি স্থগিত ঘোষণার পর আমাদের অন্যান্য বাজারক্ষেত্রে বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও সে পথে হাঁটতে পারে বলে আমরা আশংকা করি। যদি তাই হয় তবে এক্ষেত্রে আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ হবার সমূহ সম্ভাবনা।

GSP সুবিধা স্থগিত করতে আমেরিকা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন বাংলাদেশে হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে। সুস্পষ্টভাবে বললে তাদের এই অভিযোগ হয়ত ঠিক আছে কিন্তু যে খাত নিয়ে তাদের এই অভিযোগ সেই খাটি তাদের স্থগিতকৃত GSP আওতাভুক্ত না হওয়ায় তাদের এই স্থগিতাদেশের পেছনের যুক্তিকে আসলে অজুহাত হিসেবেই মনে করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ হিসেবে বলা যায়, সুবিধা দিচ্ছো তামাক আর প্লাস্টিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আর কথা বলছো তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে। হাস্যকর এবং এক তুমুল বিভ্রান্তিকর বিষয় বৈকি!

মার্কিন বাজারে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকার শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু সরকারী পদক্ষেপ নেয়ার পর পরই এই সুবিধা স্থগিত ঘোষণা আমেরিকার সত্যিকার উদ্দেশ্যকে দুরভিসন্ধিমূলক বলে মনে করাই স্বাভাবিক। আমেরিকার দেখানো পথে আর অনেকেই হয়ত সে পথ ধরে হাঁটবে। ফলে আমেরিকায় যেখানে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়নি কিন্তু অন্যান্য জায়গায় এসে ভাবমূর্তিজনিত ক্ষতি আর্থিক ক্ষতিতে রূপান্তর হয়ে যেতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। আশংকামূলক ভাবনা হয়ত বর্তমানকে উপজীব্য করে কিন্তু কে জানে ইতিবাচক মোড়ও নিতে পারে যদি সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শুধরাতে সমর্থ হন।

এ গেলো আশাবাদের কথা। এখানে কি রাজনীতি জড়িয়ে আছে। উত্তরে হয়ত একবাক্যে অনেকেই বলবেন আমেরিকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতি কেন থাকবে? থাকাও উচিত না! কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। জানা কথা, আমেরিকার সাথে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের সম্পর্ক অনেক গভীর। ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেবার পর সবচেয়ে বেশি গোস্যা হয়েছিল আমেরিকাই। ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত আমেরিকার বিভিন্ন উচ্চপদস্থদের উপদেশবাণীতে সরকার তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন সময়। ফলে ইউনুসের প্রতি দুর্বলতা এবং বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের একহাত দেখিয়ে নেয়াটাও থাকতে থাকতে পারে একটা অনুঘটক হিসেবেও।

ইদানিং আবারো আলোচনায় এসেছে গ্রামীণ ব্যাংক আর ইউনুস। সরকার যেখানে ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী নয় ঠিক বিপরিতে দেখা যায় ইউনুস বলছেন তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়বেন না। ফলে ব্যক্তি বনাম সরকারের যে দ্বন্দ সেটা প্রকট হয়ে পড়ে। তার উপর গত কয়েকদিনে বিএনপির মহাসচিব থেকে শুরু করে কয়েকজন নেতা ড. ইউনুসের সাথে দেখা করে ক্ষমতায় গেলে তাকে গ্রামীণ ব্যাংক ফিরিয়ে দেয়া হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। ফলে লবিঙয়ের সুযোগ চলে আসে ইউনুসের সামনে। অনেকের ধারণা ড. ইউনুস মোক্ষম সময়ে দাবার চাল চালেন এবং আমেরিকা সরকার ঘোষণা করে স্থগিতাদেশের। যদিও এই স্থগিতাদেশের প্রক্রিয়া ছিল অনেক দীর্ঘ।

এখানে শুধুমাত্রই কি ড. ইউনুস এককভাবে জড়িত? হয়ত তিনি অনেক বড় লবিস্ট এক্ষেত্রে কিন্তু এর আগে এই বছরের জানুয়ারির ৩০ তারিখে আমেরিকার ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার স্বনামে www.washingtontimes.com/news/2013/jan/30/the-thankless-role-in-saving-democracy-in-banglade/The thankless role in saving democracy in Bangladesh  শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। নিবন্ধে বেগম জিয়া বাংলাদেশে চরম দুঃশাসন চলছে উল্লেখ করে আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল। অথচ ইতিহাস বলে আমেরিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার সাথে সাথে পাকিস্তানকে সহায়তাও করেছিল। এবং তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর সংখ্যাক্রমে ছিল ৪৭ নম্বর। এর মানে ৪৬টা দেশ স্বীকৃতি দেয়ার পরেই তারা এক প্রকার চক্ষুলজ্জায় কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাসের প্রতি এমন দায়সারা পর্যবেক্ষণ এবং মিথ্যাচারের মাধ্যমে বেগম জিয়া চেয়েছিলেন আমেরিকার সহানুভূতি অর্জন। নিবন্ধের পাঁচ মাসের মাথায় তার কিছুটা ফলও পেয়েছেন তিনি।
 
উক্ত নিবন্ধে বেগম জিয়া ড. ইউনুসের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ দেখিয়ে আমেরিকার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন তার প্রতি অবিচার হচ্ছে উল্লেখ করে। এটা তিনি হয়ত করতেই পারেন। কিন্তু সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণা করেছেন যখন তিনি আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা বাতিল করার অনুরোধ জানানোর মাধ্যমে। বেগম জিয়ার এই কাকুতি-মিনতি দেখে মনে হয়েছিল দেশটা শুধুমাত্রই বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের। তিনি এবং বিএনপি এই দেশ কোন সুবিধা পাক তা মেনে নিতে পারছেন না। নিবন্ধের এক পর্যায়ে তিনি লিখেছিলেন- They also must explain to Ms. Hasina that general preferences for trade will be withdrawn if those who support workers’ rights and have political views opposed to those of the prime minister are not now allowed to express their beliefs. The Western powers should consider targeted travel and other sanctions against those in the regime who undermine democracy, freedom of speech and human rights. They should say and do these things publicly, for all our citizens to see and hear. This is how the United States can ensure that its mission to democratize the world continues.

(শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বোঝাতে হবে যে, যারা শ্রমিক অধিকারকে সমর্থন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিরোধিতা যারা করেন তাদেরকে যদি মত প্রকাশ করতে দেয়া না হয় তাহলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা প্রত্যাহার করা হবে। এই শাসক গোষ্ঠীর যারা গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে খাটো করে দেখে- পশ্চিমা শক্তিগুলোর তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবরোধ বিবেচনা করা উচিত। আমাদের জনগণের সামনে এসব কথা তাদের প্রকাশ্যে বলা ও করা উচিত যাতে আমাদের নাগরিকরা তা দেখতে ও শুনতে পান। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক মিশন প্রতিষ্ঠায় রত আছে তা নিশ্চিত করতে পারে।)

আমেরিকা সরকারকে সরাসরিভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের এই দাবি এবং অনুরোধ কি কোন সুস্থ এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক জানাতে পারে? অথচ ন্যাকারজনক সত্য হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া তা-ই করেছিলেন।

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশের GSP সুবিধা স্থগিত ঘোষণা হয়ত আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরণের কোন প্রভাব পড়ছে না যুররাষ্ট্রের বাজারে। কিন্তু ভাবমূর্তিজনিত প্রভাবের কারণে এর প্রভাব ইইউভুক্ত দেশসমূহে পড়তেও পারে। দেখার বিষয় এটা কিভাবে সরকার মোকাবেলা করতে পারে।

GSP সুবিধা স্থগিতের পর সরকার এবং ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে আশঙ্কার কথা শোনা গেলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কিছুটা বূনো উল্লাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের ক্ষতিতে তাদের এই উল্লাসকে যদি বেগম জিয়ার ওয়াশিংটন টাইমসে লেখা নিবন্ধের কার্যকারিতা হিসেবে দেখা যায় তাহলে বিএনপির সরকারের প্রতি দোষারোপ কি মানায়? বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে জিএসপি স্থগিতের ঘটনাকে তারা ‘দেশের জন্য কলঙ্কজনক’ বলে মনে করছে। অথচ এই জিএসপি স্থগিতের জন্যে ওয়াশিংটন টাইমস-এ নিবন্ধ লিখেছিলেন বেগম খালেদা জিয়াই। তাহলে কি অনেকেরই মতো আমরাও এমন এক অনুসিদ্ধান্তে পোঁছাতে যাচ্ছি- বিএনপি নামক দলটি ‘দেশের জন্য কলঙ্কজনক’ ব্যক্তিকেই দলের চেয়ারপার্সন হিসেবেই মান্য করছে। যদিও পারতপক্ষে আমরা এমন কোন অনুসিদ্ধান্তে পোঁছাতে মোটেও রাজি নই।  

আমেরিকা কারো বন্ধু হয় না। আমেরিকার বন্ধুত্বের সাথে তাদের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। GSP সুবিধা স্থগিত ঘোষণাকে আপাত তাদের প্রকাশ্য শত্রুতা বলে মনে করছি বলে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি ইদানীং। হতে পারে এগুলো অতি আশাবাদী কথন। ভাবমূর্তিজনিত বর্তমান ক্ষতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেই কেবল আমরা বদলাতে পারি এবং সেই সাথে দিন বদলাবেই!

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।