হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক ধ্বংসাবশেষের শেষ ঠিকানা কোথায়?

08/05/2013 14:58

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের আড়ালে ঢাকা দখলের সকল চক্রান্ত অবশেষে মাঠে মারা গেল। ইসলামী হুকুমত কায়েমের দিবাস্বপ্ন এভাবে মাঠে মারা যাবে বলে তারা ভাবেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ আর যাই হোক পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানি ভাবধারা দিয়ে চলে না। এর প্রমাণ যত খুঁজতে যাওয়া হবে ঠিক ততবারই আমাদের সামনে চলে আসবে পূর্ববর্তী ইতিহাসমূহ। আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য বলে ধর্ম নিয়ে এই দেশ কখনো ধর্মযুদ্ধে জড়ায়নি যদিও বার বার এই ধর্ম সামনে এসেছে রাজনীতির ঘুটির চাল হিসেবে। একাত্তর প্রমাণ করেছিল এবং একাত্তরের সে চেতনা ধরে সদা জাগরূক হয়ে আছে এই সময়; সেই সময়!

হেফাজতে ইসলামকে অনেকেই হেফাজতে জামায়াতে ইসলাম বলে থাকেন। এই বলার পেছনে যুক্তি আছে কারণ এই সংগঠনটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে তখন যখন দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবিতে একাট্টা হয়েছিল। গণজাগরণ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই তাদের আবির্ভাব এবং শাহবাগের জামায়াত-শিবিরবিরোধি ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কৌশলে মাঠে নেমেছিল। এরপর তাদের বহুল আলোচিত লংমার্চ এবং ১৩ দফা দাবি। এই ১৩ দফা দাবি যার সবগুলোই ছিল মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক ও কল্যাণমনস্ক কোন রাষ্ট্র এরকম দাবি মেনে নিতে পারে না। ফলাফল তাদের আল্টিমেটাম এবং ৫ মে তারিখের ঢাকা অবরোধ কর্মসুচি। বিএনপি দলীয়ভাবে তাদের ১৩ দফা দাবিকে সমর্থন দেয়নি অথচ পরস্পরবিরোধি চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছিল তাদের ঢাকা অবরোধ কর্মসুচিকে সমর্থন জানিয়ে। অবাক করা ব্যাপার, যে দল দাবিকে সমর্থন দেয় না তারা কিভাবে একই দাবি আদায়ের কর্মসুচিকে সমর্থন জানায়? কোনো দল কতটা নীতিভ্রষ্ট হলে এমন পরস্পরবিরোধি অবস্থান নেয় এবং বিপরিত ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামও কিভাবে এই সমর্থনকে শিরোধার্য জ্ঞান করে তাও প্রবল বিস্ময়ের।

হেফাজতে ইসলামের দাবি ছিল তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। কিন্তু লংমার্চ পরবর্তী সময়ে তাদের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়েছিল। তারা ১৩ দফা দাবির আড়ালে প্রকৃতই সরকার উৎখাত করে নিজেরাই ক্ষমতায় বসতে চেয়েছিল। ফলে সরকারের কোনরূপ বক্তৃতা-বিবৃতি, আহ্বানকে তোয়াক্কা করেনি এবং যে কোন মূল্যে ঢাকা অবরোধ করে জোর করে দাবি আদায় করিয়ে ছাড়বে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তারা এও ঘোষণা দিয়েছিল ৫ মে তারিখই হবে এই সরকারের শেষ দিন এবং ৬ তারিখ থেকে দেশ তাদের ১৩ দফা দাবি অনুযায়িই চলবে। ঢাকা অবরোধ পরবর্তী সমাবেশ থেকে উচ্চারিত হওয়া তাদের বক্তব্য যারা শুনেছেন তাদের উপলব্ধি হবার কথা তাদের আসল উদ্দেশ্যসমূহ। একই সময়ে তারা সমাবেশস্থল থেকে সরকারকে ঢাকা ছাড়ার জন্যে নির্দেশ দেন। তার অন্যথা হলে কেউ ফিরে যাবার পথ খুঁজে পাবে না বলেও জানানো হয়। এরকম উস্কানিমূলক বক্তব্য শুধুমাত্রই সমাবেশস্থল থেকে দেয়া হয়নি। এর আগে হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা আহমদ শফী বলেছিলেন- ৫ তারিখের পর থেকে দেশে কী হবে তা আমরা জানি না। এর বাইরে হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলেছিলেন- ১৩ দফা না মানলে ৫ তারিখ থেকে দেশ চলবে আল্লামা শফীর নির্দেশে। এবং ৫ তারিখের মধ্যে ১৩ দফা না মানলে এক দফায় যাবে হেফাজত। এবং সেটা হবে সরকার পতনের দফা অর্থাৎ একদফার আন্দোলন যার সাথে মিলে যায় বিএনপি এবং জামায়াতের দাবি যার জন্যে তারা অনেক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল। বক্তৃতা এবং কর্মসূচি দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে বেড়ে উঠা এই দলটি তারপরেও দাবি করে আসছিল তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রবল একটা বাসনা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে চালিত এই সংগঠনটির সাথে হাত মিলিয়েছিল জামায়াতে ইসলাম এবং ইসলামী ছাত্র শিবির যার সাথে একই সুরে কথা বলেছিল বিএনপিও।

আশ্চর্য্যের ব্যাপার, হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি ইসলামের রক্ষক হিসেবে বিএনপির আশ্রয়কেই মুল ভেবেছিল যদিও এই দলটি কোনক্রমেই ইসলামী দল হতে পারেনা। প্রবল নারীবিদ্বেষি হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফী এক জনসভায় বলেছিলেন দেশের নারীদের প্রধানমন্ত্রীর মত পর্দা করে চলতে হবে। এরপরেও তিনি তাদের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনকে! যে কোন সংগঠনকে যে কাউকেই নেতা বলে মেনে নিতে পারে এখানে কারো আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু মুখে নারী নেতৃত্ব না মেনে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে চরিতার্থ করতে গিয়ে অন্য কোন নারী নেতৃত্বকে মেনে নেয়া পরস্পরবিরোধি হলেও তিনি এবং তারা তা মেনে নিতে রাজি ছিলেন।

হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব এবং রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে উঠেছিল অপপ্রচার দিয়েই। শাহবাগ আন্দোলনকে বন্ধ করতে এবং জামায়াত-শিবির, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার মিশন নিয়ে তারা মাঠে নেমেছিল। এটা শুরু হয়েছিল ধর্মীয় উস্কানির মাধ্যমে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার মাহমুদুর রহমানসহ বেশ কয়েকটি জামায়াতপন্থি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া শাহবাগের রাজাকারবিরোধি আন্দোলনকে হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে সারাদেশে প্রবল ধর্মান্ধতাকে উস্কে দেয়। তারা প্রচার করে শাহবাগের সবাইই নাস্তিক ও ধর্মবিরোধি। তাদের কথিত নাস্তিকেরা নাকি আল্লাহ-রাসুলের নামে কুৎসা ছড়াচ্ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলন ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না এবং এবং এই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউই ধর্ম নিয়ে মাতামাতিও করেনি অথচ হলুদ সাংবাদিকতার তোপে পড়ে একবাক্যে সবাইই হয়ে গেল ইসলামবিদ্বেষি এবং নাস্তিক। এক সময় এই অপপ্রচারে ঘি ঢেলে দিয়েছিলেন স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শাহবাগীদের সবাইকে নষ্ট এবং নাস্তিক আখ্যা দিয়ে বসেন। বিএনপির এই বক্তব্য অনেককেই হতাশ করলেও এটা যে তাদের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি তা প্রমাণিত। এই দলটি নিকট অতীতে রাজাকার সাঈদির পক্ষাবলম্বন করে দেশের মানুষকে হতাশা আর বিভক্তির মাঝে পুড়িয়েছিল। যার খেসারত দিয়েছিল দেশ অবর্ণনীয় জামায়াত-শিবিরীয় তাণ্ডবের মাধ্যমে।

খেয়াল করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোন সভ্য রাষ্ট্রে আস্তিক-নাস্তিক বিভক্তির চেষ্টা হয় না। এরকম আন্দোলন এবং ফাঁসির দাবি করা মানে জংলি কোন রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হওয়া; দুঃখজনক হলেও সত্য এমনটাই হচ্ছে দেশেও। যা কেবলমাত্র মূর্খ এবং উন্মাদদের মাধ্যমেই হতে পারে! এবং একাধিকবার ক্ষমতাসীন থাকা একটা দল কিভাবে এই দাবিকে সমর্থন জানাতে পারে তা সামান্য বোধসম্পন্ন মানুষের কাছেও রীতিমত আশ্চর্য্যের! কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলাম ব্লগারদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছিল। তারা আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তাদের দাবিমতে কুরআন এবং হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান রাখে কিন্তু তারা কোথাও দেখাতে পারেনি পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে লিখিত আছে নাস্তিকদেরকে ফাঁসি দিতে হবে যেখানে ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ (সাঃ) মদিনা সনদে সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান নিয়ে রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। মোদ্দা কথা, ধর্মের অবমাননা ও ইসলাম রক্ষা ছিল একটা উপলক্ষ্য যা কখনোই লক্ষ্য ছিল না তাদের কাছে।

 প্রশ্ন আসতে পারে, এত কিছুর পরও হেফাজতে ইসলামকে ঢাকায় সমাবেশ করতে সরকার কেন অনুমতি দিয়েছিল? সরকার যদি অনুমতি না দিত তবে কি উচিত হত? অনেকেই এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলতে পারেন কিন্তু সরকার যদি অনুমতি না দিত তাহলে একইভাবে সারাদেশে তারা তাণ্ডব চালাতো। লংমার্চ কর্মসুচির দিনের সারাদেশের অবস্থা প্রমাণ করে তারা অনেকক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত এবং তাণ্ডব চালাতে সক্ষম। হেফাজতে ইসলামের নিজেদের প্রশিক্ষিত বাহিনী ছাড়াও সারাদেশে তাদের সহযোগীর ভূমিকায় আছে জামায়াত-শিবির। সমাবেশের অনুমতি না পেলে একইভাবে সারাদেশে হেফাজত-জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি একজোট হয়ে তাণ্ডব চালাতো। এবং হয়ত তাদের কাতারে এসে নাম লিখাতো মহাজোট সরকারের অন্যতম শরীক জাতীয় পার্টিও। লংমার্চের দিনে আমরা দেখেছি ইসলামী জোশে বলীয়ান হয়ে এরশাদ নিজে হেফাজতে ইসলামের লংমার্চের অংশগ্রহণকারীদের সাথে দেখা করেছেন, তাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, সর্বোপরি সমর্থনও দিয়েছিলেন। ঢাকা অবরোধ কর্মসুচি পরর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলাম যদি সমাবেশের অনুমতি না পেত তাহলে উল্লেখিত রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও কিছু নীরব বোধজ্ঞানহীন মানুষ এবং অতি সুশীল শ্রেণী সরকারের চৌদ্ধগোষ্ঠী উদ্ধার করেই ছাড়ত! ফলে সব দিক বিবেচনা করে সরকার হয়ত তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম কথা দিয়েছিল তাদের কর্মসুচি হবে একদিনের এবং শান্তিপুর্ণ সমাবেশে করেই তারা ফিরে যাবে। কিন্তু তারা ফেরেনি এবং দিনভর তাণ্ডব চালিয়েছে। যা ছিল ঢাকা অবরোধ নয় ঢাকা দখলের পরিষ্কার অভিসন্ধি।

হেফাজতে ইসলাম ধর্মভিত্তিক কোন সংগঠন নয়। তারা ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে বেড়ে উঠা একটা জঙ্গি সংগঠন তার সর্বশেষ প্রমাণ ৫-৬ মে তারিখের ঢাকার তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ড। ইসলাম শান্তির ধর্ম বলা হয় কিন্তু ইসলামের নাম নিয়ে এমন লঙ্কাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাস এর আগে কখনো দেখেনি বলে সন্দেহ। তারা আগুন, ধ্বংসযজ্ঞ আর মানুষ খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়েছে অবলীলায়। ১৪০০ বছরের ইসলামের ইতিহাসে কখনোই এভাবে এত সংখ্যক কুরআন শরীফ পুড়েনি কোথাও। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই হেফাজতে ইসলাম নিজেরা কুরআন এবং ধর্ম বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছিল বলে প্রচার করেছিল। তাদের নিজ হাতে কুরআন পুড়িয়ে ফেলা প্রমাণ করে ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ তাদের কাছে কোন রকমেই আবেগ এবং বিশ্বাসের কোন অনুষঙ্গ নয় যা স্রেফ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের একটা মাধ্যম।

হেফাজতে ইসলাম আলোচনায় এসেছিল মানুষের ধর্ম অনুভূতিকে পুঁজি করে এবং মাস খানেকের মধ্যেই ধর্মের আদলে গড়া তাদের হিংসাত্মক রূপ বেরিয়ে আসায় প্রমাণ হয়ে গেছে তাদের কাছে ধর্ম একটা ব্যবসায়িক উপকরণ।ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তারা নিজের হাতে পুড়িয়ে প্রমাণ করেছে  তারা ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা করতে চায়। এবং জামায়াত-শিবির এবং চিহ্নিত রাজাকারদের বাঁচাবার মিশন ছাড়া তাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। ঢাকা অবরোধের নামে ঢাকা দখলের মিশন ধর্ম রক্ষার কথিত মিশন দিয়ে শুরু হলেও এর শেষটা হল করুণ এবং অনুমিতভাবেই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংসের মাধ্যমে। ৫ মে ২০১৩, ঢাকা শহরে হেফাজতে ইসলামের অনেক তাণ্ডবের স্বাক্ষী হলেও সাথে সাথে হেফাজত নামক ধর্মান্ধ জঙ্গিদের করুণ রাজনৈতিক মৃত্যুদিনও। এখন দেখার বিষয় আমাদের রাজনীতিবিদেরা হেফাজতে ইসলামের এই রাজনৈতিক ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কে, কিভাবে টানাটানি করে এবং এর শেষই বা কোথায়?

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।