সাভার ট্রাজেডি: কালের কান্না আমি শুনতে পাই, তুমি কেন পাও না?

27/04/2013 23:13

সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর সারা দেশের মধ্যে চাঁপা কান্না বিরাজ করছে। এই কান্না এক সময় মহীরুহ আকার ধারণের অপেক্ষায়। মানুষের জীবনকে খেলনা ভাবার এই খেসারতের কোন ক্ষতিপূরণ নেই। কিন্তু তবু প্রশাসনিক রীতির কারণে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেয়া হয় এবং এর সংখানুপাতিক ভেদে আমরাও এখানে তাল মিলাই। কত কম হলো আর কতখানি বেশি হতে পারত এই নিকাশ। বিষয়টি হৃদয়বিদারক এবং মানুষের জীবনের মূল্য আরোপের একটা প্রচেষ্টা চলে আসছে। বেঁচে থাকতে যাদের জীবনের মূল্য নেই কানাকাড়ি মৃত্যুর পর তাদের লাশ সংখ্যাভেদে সামান্য কিছু টাকায় জীবনের এই মূল্যমান নির্ধারণ করে দেয়া কতখানি অমানবিক হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। অথচ এই মূল্যমান নিশ্চিত করার চাইতে সবচেয়ে জরুরি বিষয় ছিল বেঁচে থাকাকালীন সময় থেকেই তাদেরকে মূল্যায়ন করা। কিন্তু তা হচ্ছে কই?

রানা প্লাজা ট্রাজেডির আগের দিনেই ভবনে ফাটল ধরেছিল এবং মালিকপক্ষ জোর করে শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করেছে। এই ভবনে বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস ছিল এবং বরাবরের মতই তারা শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে শোষণ করে চলেছে দিনকে দিন। এই ট্রাজেডি সংগঠিত হয়েছে বলে আলোচনায় আসছে কাজে বাধ্য করার বিষয়টি। কিন্তু এরকমভাবে হাজারো কারখানায় বাধ্য করণের ব্যাপারটি চলে আসছে। এখানে মালিকপক্ষ এবং প্রশাসন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। ফাটল ধরা বিল্ডিংকে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কিভাবে নিরাপদ ঘোষণা করে এই প্রশ্ন সমানভাবে ওঠে এসেছে।

রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিহতের সংখ্যা প্রায় চারশ’। নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য। সেনাবাহিনী, সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহ গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা তাদেরকে উদ্ধারের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। দূর্ঘটনার কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও জীবিত লোক উদ্ধার হচ্ছে এটা আমাদেরকে আশাবাদী করে কিন্তু এই আশাবাদ ক্রমে মিইয়ে আসবে সময় গড়াবার সাথে সাথে। কারণ আটকে পড়াদের মধ্যে অক্সিজেনের অভাব অনুভূত হবে, না খেয়ে থাকার বিষয়টি এখানে আসছে এবং সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে আটকেপড়াদের  মানসিক অবস্থা। এখানে তাদের মানসিকভাবে দুর্বল থেকে দূর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকছে। যেহেতু প্রশাসন কাজ করছে সুতরাং আমাদেরকে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। এবং সর্বশেষ আটকে পড়া ব্যক্তি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সরকারের ঘোষিত উদ্ধার অভিযানের সফলতা কামনা ছাড়া হয়ত করার কিছু নাই।

সাভারের সংঘঠিত দূর্ঘটনাকে অনেকেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দিতে চান। আমরাও মনে করি অতি মুনাফা লাভের একটা অপচেষ্টা এখানে ছিল। গোড়াতেই গলদ ছিল যখন বিল্ডিং কোড না মেনে এই ভবনকে অনুমোদন দেয়া হয়। তখন কোথায় ছিল অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান? তারা এখন নিজেরা ত্রাতার ভূমিকায় নেমেছে মামলা করার মাধ্যমে। রাজউকের এই মামলা ইমারত আইনে হলে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা। এই জরিমানা এবং শাস্তি কি অর্ধসহস্রাধিক জীবনকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? আমরা মনে করি, এই মামলা এবং শাস্তি অতি অবশ্যই গুরু পাপে লঘু দণ্ডের তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজউকের উচিত ছিল অনুমোদন দেয়ার আগে-পরে কার্যকর তদারকির ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু তারা বরাবরের মতই ব্যর্থ হয়েছে অথবা বলা যায় নিজেরা ক্ষেত্রবিশেষে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ক্ষমতা আর অর্থের কাছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হল এমন অনেক স্থাপনা হয়ত আমাদের চারপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আরো অসংখ্য মানুষের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে। এখানে কি আমরা সচেতন হচ্ছি কোনভাবে?

 সাভার যখন মৃত্যুপুরী তখন স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের মানবতাবোধ জেগে উঠেছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ এবং গণজাগরণ মঞ্চ। মানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে সর্বোত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের মেডিক্যাল টিম সহ আরো অনেকগুলো মেডিক্যাল টিম সেখানে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্ধার অভিযানে এগিয়ে আসছে। সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো যেহেতু তাদের নিজস্ব কার্যপদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে সেহেতু অনেকক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সাথে তাদের বচসা-মতবিরোধ হবে। যদিও সবার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য অভিন্ন। মানুষের আবেগের এই জায়গাকে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখা উচিত নয় আবার একে মিডিয়ার সামনে ফলাও করে প্রচারও উচিত নয়। এর ফলে যারা দুর থেকে এই উদ্ধার অভিযানকে দেখছে তাদের কাছে ভুল মেসেজ পৌঁছাতে পারে। এমন কিছু ফুটেজ ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে এরকম প্রচার মানুষের অনুভূতিকে বিভ্রান্ত করে দেয়া ছাড়া আর কোন ফল নিয়ে আসবে না। বিষয়টি ছোট করে দেখার অবকাশ এখানে নেই।

ঘটনা ঘটে যাবার পর আমরা যে কোন বিষয় নিয়েই উদগ্রীব হই কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে তা ভুলে যাবার নজির রয়েছে। স্পেকট্রাম ট্রাজেডিসহ অন্যান্য অনেক দূর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ফলাফল তথৈবচ! অপরাধিরা শাস্তির মুখোমুখি হয় না! এবারও কি তেমন কিছু ঘটছে? আমাদের অতীত ইতিহাস বলে আমরা হয়ত কয়েকদিনের মধ্যে এই কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যুর কাহিনী ভুলে গিয়ে নতুন কোন দূর্ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করব!  একটা বিষয় আমাদেরক খুব পীড়া দেয়- যখন মৃত্যুপুরী হয়ে গেছে সাভার তখন আমাদের বাকপটু রাজনীতিবিদেরা নিজেদের বালখিল্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন অকপটে! এই দূর্ঘটনাকে হালকা করে দেখা শুরু করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি যখন বলেন- “হরতাল আহ্বানকারীরা রানা প্লাজার ভবন ও গেট ধরে টানাটানির কারণে এমন দূর্ঘটনা ঘটতেও পারে”। তখন আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি কোন উপায় থাকে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই একমাত্র ব্যক্তি নন এরকম অপরিণামদর্শি এবং হালকা কথার জন্যে। বিকল্পধারার বি চৌধুরী এই দূর্ঘটনা সম্পর্কে বলেন- “সরকার তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে”। অবস্থা এমন যেন তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করায় এই ভবন গোস্যা করেছে। ফালতু কথা আর কাকে বলে! হান্নান শাহ বলেন- বর্তমান সরকার হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন পরকল্পনা করেছে। কিন্তু সকল পরিকল্পনার মালিক আল্লাহ। আল্লাহ সরকারের সকল পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছেন”। অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হয় হান্নান শাহ’রা খুশিই হয়েছেন এমন দূর্ঘটনার জন্যে। আর অন্যদিকে সবচেয়ে হাস্যকর জঘন্য উক্তি করেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দিন রুহী। তিনি বলেছেন- “সরকার আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারই পরিণাম এই গজব”! হেফাজতের এই নেতার গজবতত্ব তার মানসিক বৈকল্যতার ইঙ্গিতবহ! আমাদের দূর্ভাগ্য আমাদের ঘাড়ে সিন্দবাদের ভূতের মত চেপে আছে আছে মানসিকভাবে অসুস্থ এমন কিছু রাজনৈতিক এবং অথাকথিত ধর্মীয় নেতারা!

সারাদেশ যখন একই অনুভূতি নিয়ে সাভারের দূর্ঘটনা কবলিতদের সাধ্যমত সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসার পথে সেখানে এ সব বাকপটু এবং বিকারগ্রস্থদের উক্তিসমূহ  আমাদের দুঃখবোধকে বাড়িয়ে দেবার জন্যে যথেষ্টই। মৃত্যুপুরী সাভারে কত মানুষ এখনো উদ্ধারের অপেক্ষায় এবং নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা কত তার হিসাব আমাদের কাছে নেই। কিন্তু মানুষের আর্তনাদ, আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ! যে হারালো তার স্বজন-পরিজন তার কাছে তাদের প্রিয় মানুষের মূল্য কতখানি তা আমার আমাদের মানবিক অনুভূতি এবং শব্দসমূহ ধারণে অক্ষম। সারাদেশ তথা যারা স্বশরীরে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে পারে নি এবং পারছে না তারাও একাত্ম এবং সমব্যথী স্বজনহারাদের সাথে। আমাদের দূর্ভাগ্য নীতিহীন যারা এবং যারা মানবিক ব্যাপারেও রাজনীতিকে ঢুকিয়ে দিতে চান তারা কবে টের পাবে স্বজন হারাদের ওমন করুণ আহাজারি আর আর্তনাদ!

সাভারের স্বজনহারাদের এই কান্না কালের কান্না। আমি আর আমরা দুর থেকে টের পাচ্ছি। তোমাকে কেন ছুঁয়ে যায় না এই গগণবিদারি মানবিক আহ্বান!  

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।