শাহবাগ আল্টিমেটাম: একটি নির্মোহ ময়নাতদন্ত

26/03/2013 12:24

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ প্রজন্ম চত্বর, শাহবাগ থেকে সারাদেশের মানুষের দাবিকে সামনে নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষিত হয় ৬দফা দাবি সম্বলিত আল্টিমেটাম। এবং এই দাবি বাস্তবায়নের জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গণজাগরণ মঞ্চ আশা করছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার সরকার এই গণদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আশাটুকু আশাবাদের ফাকা বুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জামাত-শিবির নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য দাবিগুলোর বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। যা সত্যিকার অর্থেই একদিকে যেমন লজ্জাজনক ঠিক তেমনিভাবে হতাশাজনকও বটে।

কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ের অব্যবহিত পর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন একটানা ১৭ দিন চলার পর আল্টিমেটাম এসেছিল। সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সারাদেশের মানুষ একাট্টা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের সাথে। এই আন্দোলন শাহবাগ থেকে শুরু হলেও মুহুর্তে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এমনকি দেশের বাইরেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দীর্ঘ ৪২ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মুখ থেকে প্রতিধ্বনিত হয় একাত্তরের সেই জ্বালাময়ী শ্লোগান ‘জয় বাংলা’। এই সেই শ্লোগান যা মুখে নিয়ে যে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন এক দেশের সেই শ্লোগান আবারো ফিরে আসে জনমানুষের মাঝে। দীর্ঘদিন পর ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দলীয় সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে গণশ্লোগানে রূপ নেয়। তরুণ-যুবা-বৃদ্ধ কেউ বাকি থাকেনি। প্রবল আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করে গগনবিদারি কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’। এ যেন এক দ্রোহের রূপ। সাথে সাথে তুমুল ধিক্কার আর ঘৃণায় মানুষ জামায়াতিদের বর্জন করে ‘তুই রাজাকার’ ধ্বনিতে। যা গত ৪২ বছরের ইতিহাসে ছিল এক প্রকার তুমুল ভয় জাগানিয়া এক শব্দযুগল! রাজাকারদের রাজাকার বলে ধিক্কার দেয়ার এই সাহস সঞ্চারিত করেছে শাহবাগ আন্দোলন।

২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ গণজাগরণ মঞ্চের সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত আল্টিমেটামের সময়কাল। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক কি ছিল এই আল্টিমেটাম:
দাবি-১. ঘাতক জামাত শিবিরের সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ রাজীব হায়দার, জাফর মুন্সী, বাহাদুর মিয়া, কিশোর রাসেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আগামী সাতদিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
দাবি-২. ২৬ মার্চের পূর্বে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশোধিত আইনের অধীনে অভিযোগ গঠন এবং নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
দাবি-৩. অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গিবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
দাবি-৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যনালকে স্থায়ীরূপ দিতে হবে।
দাবি-৫. গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তাণ্ডব বন্ধে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সকল সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ গোপন আস্তানাসমূহ উৎখাত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করে দিতে হবে।
দাবি-৬. যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক এবং হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।


এই সময়ে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক দূর। দেশে ঘটেছে অনেক কিছুই, ইতিবাচক-নেতিবাচক। ইতবাচক কিছুর দিকে তাকালে দেখা যাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ যুদ্ধাপরাধী এবং প্রমাণিত রাজাকার দেলোয়ার হোসেইন সাঈদীর মামলার রায় হয়েছে। এবং প্রত্যাশিতভাবেই তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এই ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে জামায়াত-শিবির যে তাণ্ডব এবং সন্ত্রাস চালিয়েছে সেটা একটা বিশাল নেতিবাচক এবং আতঙ্কিত হবার মত সংবাদ। চাঁদে সাইদীকে দেখা যাচ্ছে এই গুজব সৃষ্টি করে বগুড়া,চট্টগ্রাম,লালমনিরহাট,কুষ্টিয়া,পটুয়াখালী,রাজশাহীসহ জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকার অনেক জায়গায় মসজিদের মাধ্যমে গভীর রাতে মানুষ জড়ো করে তাদেরকে উস্কানি দিয়ে সেখান থেকে সরকারী স্থাপনা ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং মন্দিরে হামলা করেছে জামায়াত-শিবির, হত্যাকাণ্ড হয়েছ; হয়েছে লুটপাটও। রায়ের অব্যবহিত পর থেকে শুরু করে এক সপ্তাহে দেশে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসে খুন হয়েছে অন্তত শ’খানেক লোক। প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে- যা হতাশাজনক।

গণজাগরণ মঞ্চের ৬দফা দাবির প্রথম দাবিতে উল্লেখ ছিল জামায়াত-শিবিরের হাতে নিহতদের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল এই ক’দিনে ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের মধ্যে মাত্র ছয়জন খুনিকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়ে প্রশাসন। গ্রেফতারকৃতদের জবানবন্দীতে স্পষ্ট হয়েছে এর সাথে জড়িত ছিল আরো অনেকেই। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি অথবা গ্রেফতারের জন্যে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উপরন্তু মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু নাম। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, গোলাম আযমের মামলার অন্যতম সাক্ষী সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই এবং সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগতজ্যোতি তালুকদার। এখানেও ব্যর্থ প্রশাসন। তারা না দিতে পেরেছে নিরাপত্তা, না করতে পেরেছে খুনিদের গ্রেফতার!

দ্বিতীয় দাবিটি জনমানুষের মুখে মুখে মুখে উচ্চারিত যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণের। কিন্তু দীর্ঘ এক মাসাধিক কাল অতিক্রমের পরও এই দাবি নিয়ে সরকারের মধ্যে কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। প্রথম দিকে সরকার এবং আওয়ামীলীগের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা ইতিবাচক কথা শোনা গেলেও কালক্রমে তা মিইয়ে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার এ নিয়ে কিছুটা রাজনীতি করতে চায় নির্বাচনী মুলা ঝুলানোর মাধ্যমে। আওয়ামীলীগের উচ্চপর্যায়ের কিছু নেতার মুখে এই দাবির স্বপক্ষে কথা শোনা গেলেও তাদের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি মহান জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার যে সংসদ সদস্যগণ প্রস্তাব তুলবেন তারা নিজেরাও দাবি জানিয়ে গেছেন। ফলাফল তথৈবচ! এর মধ্যে অবশ্য জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে হাইকোর্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলা পুনরায় আলোচনায় এসেছে। হাইকোর্টে এ নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বেঞ্চ গঠিত হয়েছে। সে ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকেই। অবশ্য এই রিটে জামায়াতে ইসলামী পরাজিত হলে তাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হবে। যদিও এই মুহুর্তে তাদের নিবন্ধনের ব্যাপারটি এখনো সুরাহা হয়নি। অথচ আমাদের সংবিধানের ৩৮(গ), ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০(১) এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনেই জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা যায়। এর জন্যে প্রয়োজন ছিল সরকারের সদিচ্ছা কিন্তু এর অভাব প্রকট বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ের সন্ত্রাস, দেশকে গৃহযুদ্ধের হুমকি ইত্যকার নানা বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকৃতই সন্ত্রাসনির্ভর জঙ্গি সংগঠন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনের অঙ্গীকারের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাদেরকে নির্বাহি আদেশেই নিষিদ্ধ করা যেত। এটা ব্যক্তিক্রমী কোন দৃষ্টান্ত হিসেবেও পরিগণিত হয় না কারণ এর আগে নির্বাহি আদেশে আরো কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়ছিল। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রমাণিত দল জামায়াতে ইসলামী সে ঘোষণাও দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রায়ের আদেশে। দেশের স্বাধীনতা এবং জন্মের যারা বিরোধিতা করে তাদের এই দেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার থাকতে পারে না।

জামায়াত-শিবির শুধুমাত্রই সন্ত্রাসের মাধ্যমেই দেশের অগ্রগতির যাত্রাপথকে রুদ্ধ করছে তা নয়। তাদের পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সারাদেশে তাদের সন্ত্রাস এবং জঙ্গি অর্থায়নের মূল উৎস। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তারা জঙ্গিদের অর্থায়নে ব্যয় করছে। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এর উৎস খুঁজে বের করে প্রয়োজনে সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা যাতে করে জঙ্গি অর্থায়নের জন্যে তা ব্যয়িত না হয়। এক মাসের সময়ে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে আশার কথা, ইতোমধ্যে জনগণ স্বতপ্রণোদিত হয়ে নিজেরাই জামায়াত-শিবিরের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিচ্ছে। খবরে প্রকাশ, ইসলামী ব্যাংক থেকে মানুষ নিজেরাই ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে। তাদের বিদেশী বিনিয়োগকারী বিশেষ করে কুয়েতের চারটি প্রতিষ্ঠান তাদের ১৫% শেয়ার বিক্রি করে দেবার ঘোষণা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে অনুমতিও নিয়েছে। ফলে বিরাট এক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা তা বলাই বাহুল্য। এর বাইরে বিদেশি বেশ কয়েকটি কোম্পানি ঋণপত্রে ইসলামী ব্যাংকে এডভাইজিং ব্যাংক হিসেবে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যেখানে সরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল সেখানে অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আঘাত আসছে জামায়াত-শিবিরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) এই মুহুর্তে যে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে তারাই সর্বশেষ চিহ্নিত রাজাকার নয়। এর বাইরেও আরো অনেক যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার রয়েছে। আরো কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এবং পর্যায়ক্রমে তাদের বিচারও হবে। গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করেছে এই ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপদানের। কারণ কেবলমাত্র স্থায়ী রূপদানের মাধ্যমে এই আদালত স্থায়িত্ব পেত। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেও এই আদালত একইভাবে একই ধরণের অপরাধের জন্যে বিচার করতে পারতো। কলঙ্কমোচনের একটা চিরস্থায়ী রূপের জন্যে যা খুবই প্রয়োজন ছিল। আল্টিমেটামের এক মাস অতিক্রমের পরেও এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা আসেনি। তবে আশার কথা আরো কিছু অভিযোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্থাপনের অপেক্ষায় এবং একটা সময়ে হয়ত স্থায়ী রূপ দেয়ার চিন্তাভাবনা আসতে পারে।

আরব বিশ্বসহ বেশ কিছু মুসলিম প্রধান দেশের কাছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন। ফলে সেখান থেকে তারা প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য পেয়ে আসছে। যা খরচ করছে সারাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে। দেশের মধ্যকার তাদের ভয়ংকর সন্ত্রাসীরূপ বাইরে প্রচার হয় না বলে তাদের জন্যে সুবিধা হয়েছে। ভেতরের রূপ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক লবিঙয়ের মাধ্যমে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সারাদেশে রয়েছে তাদের সুশৃঙ্খল ক্যাডার বাহিনী। যাদের হাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। ফলে তারা ভয়ংকর হয়ে ওঠছে ক্রমশ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে তারা এই রকম পেশিশক্তি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। কোন সরকারই তাদেরকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসেনি উল্টো লালন-পালন করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের একটা অন্যতম দাবি ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার। কিন্তু গত এক মাসের বেশি সময়ে এই ধরণের কোন অভিযান পরিচালিত হয়নি। সাঈদির রায়ের পর যে সন্ত্রাস পরিচালিত হয়েছে তাদের দ্বারা এটা তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের একটা অন্যতম নজির। উপরন্তু রয়েছে দেশের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি। এত কিছুর পরও তাদের বিপক্ষে তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

গণজাগরণ মঞ্চের ৬য় দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের দোসর মিডিয়া এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কারণ মিডিয়া জনমত সংগঠনের ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিছু মিডিয়া বিশেষ করে মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ, সংগ্রাম, ইনকিলাব, নয়াদিগন্ত এবং দিগন্ত টিভি সংবাদের নামে যা প্রচার করছে তা স্রেফ মিথ্যাচার। উল্লেখিত মিডিয়াগুলো বিশেষ করে আমার দেশ পত্রিকা সংবাদের নামে হলুদ সাংবাদিকতাকে লালন করে আসছে। তাদের উস্কানিতে ২২ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের আড়ালে জামায়াত-শিবির ব্যাপক সন্ত্রাস করেছে, হামলা করেছে শহীদ মিনারে, ছিড়েছে জাতীয় পতাকা এবং ভাংচুর করেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত তারুণ্যের অবিনশ্বর কীর্তি গণজাগরণ মঞ্চ। এর নেপথ্যে রয়েছে মাহমুদুর রহমান। তাকে গ্রেফতার করতে বিভিন্ন সময়ে দাবি জানানো হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি। ফলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে হলুদ সাংবাদিকতা প্রচার করেছে। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর একমাত্র মাহমুদুর রহমানই। তার টিকিটি ধরার সাধ্য কারো নেই। সারাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে তখন যুদ্ধাপরাধীদের দোসর মিডিয়াগুলো দেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে অবলীলায়। ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-লুটপাট হয়েছে। আস্তিক-নাস্তিক ধোঁয়া তুলে জাতিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করছে। এক শ্রেণীর মৌলবাদীকে উস্কানি দিয়ে মুক্তমতের মানুষের ওপর হামলাকে বৈধতার চাদরে লেপটে দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের। এই ধরনের অপমিডিয়ার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জোরালো হলেও এ নিয়ে সরকারের মধ্যে কোন মাথাব্যথা নাই। উপরন্তু মুক্তমতের মানুষের ওপর নেমে আসছে সরকারের তীব্র খড়গ। বিটিআরসি নামক সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্লগে ব্লগে চিঠি দিয়ে ব্লগারদের ব্যক্তিগত তথ্য চাচ্ছে, মুছে দিতে বলছে লেখাগুলো। তবে আশার কথা সুস্থ চিন্তার ব্লগগুলো এই উদ্যোগের প্রতিবাদ করছে।

গণজাগরণ মঞ্চের আল্টিমেটাম এবং এক মাসের সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি খেয়াল করলে অনেকেই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেখে হতাশই হবেন হয়ত। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি হতাশ নই। কারণ এই শাহবাগ আন্দোলন যেমন কারো একার উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি এবং কেউ একা এর মূলেও না। এক থেকে পাঁচ হয়ে এই আন্দোলন এখন সারাদেশের মানুষের দাবিকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রান্তিক মানুষ নিজেরাই নির্ধারণ করে নিচ্ছে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। তাই সরকার যেখানে ব্যর্থ কিংবা দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে কিংবা অপারগ সেখানে মানুষ নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে যেমন কেউ গভীরভাবে ভাবছে না তেমনিভাবে জাগরণকে আগামী দিনের পাথেয় হিসেবে দেখছে সবাই।

বিপ্লব কিংবা আন্দোলন হয়ত শুরু হয় হুট করে কিন্তু এর ফল আসে ধীরে। ধীরে আসা ফলের স্থায়িত্বও দেশি। কেউ ভাবেনি বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীন হতে সময় লাগবে আরো ঊনিশ! ঠিক তেমনিভাবে হয়ত রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে যে আন্দোলন শুরু হল দুই হাজার তেরোতে তার চূড়ান্ত ফল আসবে কবে! তবে আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস বলে বাঙালী হারে না। তারা জেতে এবং জেতেই চলে! বাঙালীর এই বিজয়রথ আগেও যেমন কেউ থামাতে পারেনি; এখনো পারবে না!

মানুষ শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান যেমন নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে তেমনিভাবে পেরেছে সমুচ্চ ধিক্কার জানিয়ে বলতে ‘তুই রাজাকার’। মানুষের মাঝে একাত্তরের চেতনা আর দেশপ্রেম যেভাবে জেগে ওঠেছে সেটাকে যদি অর্জন হিসেবে ধরে নিই তবে বলে দেয়া যায় এই দেশের জনগণ যেমন হারেনি একাত্তরে তেমনিভাবে হারবে না এই দুই হাজার তেরোতেও! সরকার আসবে-যাবে কিন্তু চেতনা রয়ে যাবে আজন্ম। এই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে শাহবাগ আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এর হাত ধরেই!

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।