মহান মে দিবস: শ্রমিক আমি তবু মানুষই তো!

01/05/2013 00:26

১৮৮৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল,মাঝখানে কেটে গেছে শত বছরেরও বেশি সময়। শিকাগো শহরের হে মার্কেট থেকে যে আগুনের শিখা জ্বলেছে তা দিনে দিনে শহরে-শহরে ছড়িয়েছে। আন্তরিকতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে ক্রমে রূপ নিয়েছে দিবসি আলংকারিক আয়োজনে। ঘটা করে দেশে-দেশে,শহরে-শহরে পালন হচ্ছে। মালিক হয়ে  আসছে প্রধান অতিথি! মঞ্চে উঠে বলে যায় শ্রমিক অধিকারের কথা। খানিকক্ষণ বাদে ভুলে যায় যা বলেছিল আর যা করার দরকার ছিল তার সবকিছুই একেবারে না ভুলেই। এ এক অদ্ভুত নিয়তি!

ইতিহাসের সে কাহিনী, দাবি ছিল আট ঘন্টা শ্রমের। মালিকেরা তা মানবে কেন! তাই চললো গুলি! মারা পড়লো কয়েকজন যাদের নাম জানা অথবা অজানা। অতঃপর শ্রমের মূল্যায়নসহ আটঘন্টা শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা পেল! তারপর ধীরে ধীরে সময়ের বিবর্তনে আদায়কৃত দাবি আড়ালে পড়ে যেতে পোষাকী আধুনিকতার! যার রেশ এখনো চলছে; চলবে হয়ত!

এই দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি আসলে অতিলোভ আর অব্যবস্থাপনার কবলে দিন দিন বন্দী হয়ে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিক হারাচ্ছে তার ন্যায্য দাবি আর বিপরিতক্ষেত্রে মালিকেরা ক্রমে হয়ে উঠছে অসহ মাত্রায় বেপরোয়া। শ্রমিক হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে মৃত্যুঝুঁকিতে শ্রমিক। তাই বার বার আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়ে উপস্থিত হয়ে যায় স্পেকট্রাম, সাভার ট্রাজেডিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনাসমূহ। শ’য়ে শ’য়ে সতেজ প্রাণ মুহুর্তে হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। আর আমরা শোকবিদীর্ণ হয়ে কয়েক দিনের ব্যবধানে ভুলে যাই। আবারো একই মাতমে মেতে ওঠি যখন পূণর্বার একই কাহিনী! এই শোক, শোকপ্রকাশ, কালোব্যাজ আর পোশাকি শ্রমিক অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় বাস্তবতায় এসে যখন আমরা নিজেরা নিজেদেরকে ভেবে বসি একজন মালিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে। অথচ খুব সহজ করে ভাবলে কী দেখা যাবে না এই মালিকত্বের পেছনের ইতিহাসে আমরা কোন না কোন ভাবে স্বতন্ত্র পরিচয়ে একজন শ্রমিকও!

শ্রমিক-মালিকতত্বের আড়ালে খেলে চলে যারা কালের হিসেবে তারা নিজেরা যখন নিজেদের মালিক ভাবতে শুরু কে তখন আসলেই সামাজিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে একটা বিরাট আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের আত্মীয়-স্বজন-পরিজন যখন বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে আর দেশের অর্থনীতিতে জ্বালানি যোগায় তাদের কেউই সেখানে প্রচলিত ধারার মালিক হিসেবে থাকে না। কোন না কোন ভাবে শ্রম বেঁচে খায় বলে তারা কি শ্রমিক না? আর তাদের অর্থে চালিত  আমাদের আমরা এখানে এসে মালিক সেজে বসে যাওয়া রীতিমত হাস্যকর বৈকি! অবাক করা ব্যাপার অনেকক্ষেত্রে এমন অস্বাভাবিক ব্যাপার স্বাভাবিকতায় রূপলাভ করে বসে আছে।

মানুষ হয়েও মানুষের প্রতিভূ সেজে বসার সহজাত অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা মানুষের মাঝে প্রবল। তাই শ্রমিক বলে যাদের জ্ঞান করা হয় তাদের জীবনের কানাকড়িই মূল্য নেই মালিক নামক শোষক প্রভুদের কাছে। তাই স্পেকট্রাম পুড়ে, ছাই হয় শ’য়ে শ’য়ে লোক। সাভারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করতে বাধ্য করে মালিকপক্ষ। ফলে অসংখ্য প্রাণ মুহুর্তে অসাড় হয়ে যায়। আমরা শোকপ্রকাশ করে দায় সারতে চেষ্টা করে যাই। অর্র্থের মূল্যে মানুষের জীবনকে নিরূপণ করে কিছু সাহায্যের ঘোষণা দিয়ে বসে পড়ি ফি-বারের মত! মানুষ কতখানি নির্মম হলে এমন করতে পারে ভেবে অবাক হই আমরা তারা যারা হয়ত এখানে স্বার্থ নিয়ে নিয়োজিত নই! ভেবে দেখার দরকার আছে, ব্যক্তি আমি যখন শ্রমিক নই তখন আমার কাছে যারা শ্রমিক তাদের প্রতি কতখানি দায়িত্ব পালন করেছি? সুযোগের অভাবে যদি নীতিবান সাজি তাহলে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনাই থাকে না।

দেশে এই মুহুর্তে যখন মে দিবস পালিত হচ্ছে তখন শ্রমিকের রক্ত-প্রাণে সাভার এক মৃত্যুপুরী। তাদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে এবং হবেও। শোকপ্রকাশে মিডিয়া তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলেছে অথচ দিন কয়েক বাদেই সব হয়ে যাবে আগেকার মত সুস্থির আর শান্ত। কিছুদিন পর থেকেই আবারো বাধ্য করার ব্যাপারটি চালু হয়ে যাবে আগের মতই। কোন সংবাদই আসবে না বাইরের মানুষের কাছে। মানুষের জীবনের এমন নগ্ন মূল্যায়ন চলতে থাকবে যুগ যুগ ধরে আর নিপীড়িত হতে থাকবে শ্রমিক; ফি-বার!

এই শ্রমিক দিবস অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতই বেঁচে থাকার নূন্যতম নিশ্চয়তা দিতে পারবে না আরো অনেক শ্রমিকদের মত চা-শ্রমিকদের। ভাবা যায়, বর্তমান দূমূল্যের বাজারে এখনো তাদের দৈনিক মজুরি মাত্র পঞ্চান্ন টাকা। এই পঞ্চান্ন টাকায় কিভাবে চলতে পারে একটা মানুষ-পরিবার? যেখানে এক কেজি চালের দাম দৈনিক মজুরির অর্ধেকের চাইতেও বেশি! চা-বাগানে বসবাসরত এই সব চা-শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরেই মজুরি বৃদ্ধির ন্যায্য দাবি জানিয়ে আসছেন কিন্তু কেউই তাদের দিকে ফিরে তাকায়নি।

চা-শ্রমিক, পোশাক শ্রমিকসহ শ্রম বিক্রি করে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করে চলছে যে সব শ্রমিক তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সবাই কেমন উদাসিন। সরকার-প্রশাসন-মালিকপক্ষ একে অপরকে সাহায্য করে শ্রমিকদের দাবিকে উপেক্ষা করে চলছে দিন দিন। এভাবে কত? কিন্তু মে দিবস আসলেই কেবল ডাক পড়েশ্রমিকদের। তাদেরকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে সবাই সাজতে চায় মহৎপ্রাণ! আমাদের বিস্ময়াভিভূত চোখ তাড়া করে অবাক বিস্ময়ে অথচ কোন প্রতিকার নেই!

যাদেরকে আমরা প্রচলিত ধারায় শ্রমিক বলে থাকি তারা কেবলমাত্রই শ্রমিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে তা নয়। ব্যক্তি আমি আর আমরা যারা শ্রম বেঁচে খাই তারাও কি শ্রমিক নয়? অথচ আমার চারপাশ প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে আমাকে-আমাদেরকে শ্রমিক বলে মনে করে না। আমি আমাকে শ্রমিক বলতে চেয়েছি অনেকের কাছেই কিন্তু প্রতিবারই শ্রোতা করুণ চোখে তাকিয়েছে আমার দিকে। হয়ত বিশ্বাস করাতে পারিনি তাদেরকে তবু নিজেকে শ্রমিক ভাবি। কারণ আমাকেও রোজ রোজ কাজে যেতে হয় নিয়ম করে। যাওয়ার অথবা শুরুর সময় নির্ধারিত থাকলেও আমার ফেরার নির্দিষ্ট সময় থাকেনা।

একজন শ্রমজীবী বলে এ আমার অনন্ত আক্ষেপ! যখন তোমরা  শ্রমিককে শ্রমিক ভেবে বসে আছো অথচ মানুষ ভাবো না। বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত শোক, শোষণ আর দুর্ঘটনা আমার শ্রমিক মনকে বিদীর্ণ করে দিয়েছে যার চুড়ান্ত— রূপ দেখেছি আমি এই ক'দিনে। তোমরা যতই আমাকে কর্পোরেট ধন্দে বন্দী রেখেছো। আমি এ খাঁচা ভাঙবোই একদিন। শ্রমিক বলে আমাদেরকে আর কতভাবে কোণঠাসা করে রাখবে তোমরা। মালিক হয়ে তোমরা হতে পারো ক্ষমতাধর কোনো এক কিন্তু মন থেকে বলছি তোমাদের কোন মূল্য নেই আমাদের কাছে যতক্ষণ না তোমরা শ্রমিকদের শুধুমাত্র শ্রমিক হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে মনে করো। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয় তোমরা মানুষ হতে পারোনি আজো। জেনে রাখা উচিত, মানুষ হওয়াটা বড় কঠিন!

হয়তো আমি সংজ্ঞায়িত শ্রমিক নই তবু আমিও তো শ্রম বিক্রি করে চলেছি সেই শুরুকায় থেকে। তোমরা আমাকে শ্রমিক অথবা মানুষ কিছুই না ভাবলেও আমি সে সব শ্রমিকদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছি যারা রোজ রোজ কাজ করে বিকেলে অথবা একটা নির্দিষ্ট সময় অথবা দিন শেষে পথ চেয়ে থাকে শ্রমমূল্যের। আমিও তেমনই এক তবে আমাকে শ্রমিক বলতে আপত্তি কোথায় তোমাদের! শ্রম বেঁচে যারা খেয়ে পরে থাকে তাদের শ্রমিক ভাবতে গেলে উচু আর নিচুতলার বিভাজনে আমি বিশ্বাসী নই মোটেও। যেখানে শ্রম বিক্রি অতঃপর শ্রমমূল্য সেখানে শ্রমিক না বলে যদি বলা হয় কর্পোরেট চাকর তবে আমার খানিক বিদ্রুপ-হাসি ছাঙা আর উপায় থাকেনা!

আমি-আমরা শ্রম বিক্রি করে খাই তাই আমার গা শুষেই শুধু নয় মগজ ধোলাই করে শুষে নিচ্ছো তোমরা সব। বিনিময়ে কী দিলে; হতাশা,শুধু হতাশা আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা! অথচ ভেবে দেখো আমরা শুধুমাত্র স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আর ন্যায্য শ্রমমূল্য চেয়েছিলাম তোমাদের কাছে।

আমরা শ্রমিক, আমরা স্ব স্ব যোগ্যতায় আমাদেরকে গড়ে তুলে অবদান রাখছি দেশের অর্থনীতিতে। এই অস্বাভাবিক জীবন আর নিত্যকার শোষণের পরেও আমরা বেঁচে থাকার গ্যারান্টিই চাই শুধুমাত্র। তোমরা মালিক হতে পারো কিন্তু মনে রেখো শেষ বিচারে আমরা হয়ত কোনদিনও মালিক হতে চাইব না, শুধুমাত্র হতে চাইব একজন মানুষ; সত্যিকার অর্থেই মানুষ!
 

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।