চেতনায় ঘুণ ধরে না

08/04/2013 23:21

সময় বদলে অনেকেরই চেতনা বদলায় না। শুধুমাত্র রূপবদলে সামনে আসে লেবাস আর নানা ছল। একাত্তর থেকে ২০১৩ সময়ের ব্যবধান মাত্র ৪২ বছর। মাত্র শব্দটি এখানে আপেক্ষিক। অন্তর্গত অর্থের দিক থেকে মাত্র কেবলমাত্র মাত্রই না! একাত্তরের ঘাতক-দালাল, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিকমিটি নতুন নামে পুরোনোরূপে! অতি অবশ্যই হতাশার!

একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পরিণতিতে যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামীলীগ। তখন তারা ছিল ক্ষমতার বাইরে, আন্দোলনের মাঠে। আর ২০১৩ সালে এসে এই সময়ে তারা ক্ষমতায়। একাত্তরে যেমন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের চর, ব্রাহ্মণ্যবাদী দালাল, মালাউন, কাফের, ইসলামবিরোধী, দুষ্কৃতিকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধা। ঠিক একইভাবে এই সময়ে এসে একইভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ফ্যাসিস্ট আর নাস্তিক অভিধা। স্বদেশের স্বাধীন আলো-হাওয়ায় মুক্তচিন্তা বারে বারে পদদলিত হচ্ছে অদ্ভুত মিথ্যাচারভিত্তিক অপপ্রচারের মাধ্যমে।

ইসলাম নিয়ে মস্করা করেছিল তখন জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামী ইসলামী নামক কয়েকটি দল। তারা ‘ইসলাম গেল গেল’ রব তুলে সারাদেশের মানুষকে বিভক্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ফলে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল মানচিত্র আর পতাকা। বাংলাদেশের এই অর্জনের সাথে সাথে বন্ধ হয়েছিল দলীয় সিদ্ধান্তে দেশের বিরোধিতা করতে যাওয়া জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করার অধিকার। অথচ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী আবারো ফিরে আসে রাজনীতিতে। পূণর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধীরা। সংবিধান থেকে মুছে দেয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। পাকিস্তানী আদলে বাংলাদেশ গড়ার প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত হয়।

একাত্তরের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রধানতম সাইনবোর্ড গোলাম আযম বাংলাদেশে আসে মেজর জিয়ার শাসনামলে। পাকিস্তানি এই নাগরিক তার অসুস্থ মাতাকে দেখতে আসার নামে বাংলাদেশে আসে। প্রতিবাদ করার জন্যে খুব বেশী লোক পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূর-উজ্জামানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার এই আগমনের জোরালো প্রতিবাদ করেন। ফলে মাওলানা মান্নানের ইনকিলাব নামক পত্রিকা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছিল। ধর্মান্ধ এই গোষ্ঠীদের কাছে গোলাম আযম মানে ইসলামের প্রতিশব্দ। একাত্তরের গণহত্যার মুল পরিকল্পনাকারী হিসেবের বাইরেও এই গোলাম আযম গং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে মক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর অপপ্রচার চালিয়েছিল বাংলাদেশে ইসলাম বিনষ্ট হয়েছে বলে। ফলে ওআইসি এবং বেশ কিছু ইসলামী দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনেক দেরি করেছিল।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সর্বশেষ সাংবিধানিক পেরেক ঠুকে দেন জেনারেল এরশাদ। কলমের খোঁচায় দেশের ওপর লেগে যায় ধর্মীয় লেবাস। গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জোট। নেতৃত্বে ছিলেন-  আহমদ শরীফ, শাহরিয়ার কবির, সিরাজুল ইসলাম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু তারা খুব সহজে এই জোট গঠন করে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে পারেন নি। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু আর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন আবারো। রাজাকার মান্নানের ইনকিলাব পত্রিকা তাদের বিপক্ষে নেমে পড়ে সম্মুখ সমরে। ফলে হেন কোন অভিধা বাকি থাকেনি তাদের জন্যে। তবু আশার কথা তারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন এবং লৌকিক কোন অর্জন ঘরে তুলতে না পারলেও চেতনার বীজকে প্রোথিত করেছিলেন সবার মাঝে। যা এক দাবানল হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৯২ সালে যখন জামায়াতে ইসলামি তাদের ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ থেকে রাজাকার আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে দিয়ে গোলাম আজমকে "আমীর" ঘোষণা করলো তখন চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সামনে চলে আসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। বিশাল গণজাগরণ সৃষ্টি হয় দেশ জুড়ে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদণ্ডতূল্য বলে ঘোষণা করলেন। এই আদালত ছিল প্রতীকী কিন্তু এর জাগরণ ছিল সত্যিকার অর্থেই বাস্তবিক। মানুষের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায় এ আন্দোলনের মাধ্যমে। জাহানারা ইমামের এই গণআদালতের রায় এবং পরিণতি খুব সুখকর ছিল না বৈরি সরকার এবং রাজনৈতিক অবস্থার কারণে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন থাকায় তাদেরকে মামলার মুখোমুখি হতে হয়। জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মামলা করে বিএনপি-জামায়াত সরকার। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়ে এক সময় আমেরিকায় মৃত্যুবরণও করেন। থেমে যায় যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারদের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বরগুলো!

একাত্তরে চেতনার বাংলাদেশ থেকে আস্তে আস্তে লুপ্ত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু কেউ কি ভেবেছিল আবারো জেগে ওঠবে মানুষগুলো শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দেখানো পথে! কেউ না ভাবলেও নতুন প্রজন্ম ঠিকই সে পথ ধরে এগিয়েছিল। এর শুরু হয়েছে অনলাইন বিশেষ করে ব্লগ থেকে। বাংলা মধ্যবিত্ত সমাজের প্রাগ্রসর চিন্তার তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘদিন ধরে তাদের মাঝে চেতনার যে মশালকে ধারণ করেছিল তা অগ্ন্যুৎপাত হয়ে স্ফুরিত হয় যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের দণ্ডের পর। দেশবাসী নেমে আসে রাস্তায় এক দাবিতে রাজাকারদের দাবিতে। এর সাথে একইভাবে ওঠে আসে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি। কারণ এই দল একাত্তরে দলীয় সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং যাবতীয় মানবতাবিরোধি অপরাধও সংঘঠন করে তারা। আদালত যুদ্ধাপরাধীদের রায়েও এই বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।

সারা দেশ যখন একাট্টা অভিন্ন দাবিতে তখন একাত্তরের মতই আবারো অপপ্রচারে নেমেছে কিছু মিডিয়া। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম, মর্নিং নিউজ পত্রিকা। দুই হাজার তেরোতে একইভাবে একই সূত্রে গাঁথা আছে তাদের কিছু মিডিয়া। মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ, দৈনিক সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব এবং দিগন্ত টিভি একইভাবে আছে তাদের পূর্বসূরিদের ভূমিকায়। একাত্তরে মিডিয়ার স্পেস কম ছিল বলে খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছাবার সুযোগ ছিল কম। কিন্তু এই সময়ে অন এয়ার স্পেস বেশি থাকায় অপপ্রচারের মাত্রাও বেশি! ফলে আমার দেশ এবং তাদের সমমনা মিডিয়াগুলো বিভিন্নভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে অপপ্রচারের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার দেশ আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুতে সারাদেশে তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লাগে। একটা শ্রেণীর মানুষের মাঝে এই সময়ের পথনির্দেশক ব্লগারদের মোটাদাগে নাস্তিক এবং ইসলামবিরোধী আখ্যা দেয়। ইসলাম ধর্মের মানুষের ধর্মানুভূতিকে পুঁজি করে ঈমানী জোশ(!) উস্কে দেয়। ফলত কিছু মানুষ ব্লগারদের ধর্মের বিরুদ্ধশক্তি মনে করছে যারা ব্লগ সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না। এটা সাংবাদিকতার নামে যে প্রতারণা তা অনুধাবণ করতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না!

এখন এই ২০১৩ সালে এসে বাঙালীর জাগরণ হয়েছে আবার। এই জাগরণ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আর জামায়াত- শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে। এই জাগরণের পর্যায় শুরু হয়েছে তারুণ্যের অদম্য স্পৃহা থেকে। সাধারণ মানুষও এর সাথে মিলিত হয় চেতনার আহ্বানে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে এই আন্দোলন রূপ নেয় এক গণআন্দোলনে। গোটা দেশ একাত্ম হয় একাত্তরের ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হাতগুলো হয়ে ওঠে ইস্পাতকঠিন।

বাঙালির এই জাগরণকে ভিন্নখাতে নেবার জন্যে সারাদেশে জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালায়। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়। সৃষ্টি হয় হেফাজতে ইসলাম নামক জামায়াত-শিবিরের অবিকল নকল একটা সাম্প্রাদায়িক সংগঠন। সরকার পিছু হটে কিন্তু পিছু হটেনি তারুণ্যের স্পর্ধা গণজাগরণ মঞ্চ। সবাই যখন নিজেদের মাথাকে বিক্রি করে দিতে চায় ধর্মান্ধদের কাছে তখনো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগ আর সারাদেশের গণজাগরণ মঞ্চ।

এই সময়টা অনেক কঠিন। এই সময়টা নিজেদের চেতনাকে শান দেবার সময়। একাত্তরে হারেনি আমাদের পূর্বপুরুষ এটাই আমাদের অনুপ্রেরণা। এই অনুপ্রেরণাকে ধারণ করে এই প্রজন্ম এগিয়ে চলছে রাজাকার আর জামায়াত-শিবিরমুক্ত সুস্থ বাংলাদেশের দিকে।

 

আমি তৈরি; আপনি তৈরি ত!

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।