আমরাও ব্যর্থ হবো না

18/03/2013 01:55

মাকে যেমন প্রবল আবেগে সম্বোধন করি, তেমনি দেশকেও। দেশ আর মা তাই সমার্থক। ইতিহাসের পরিক্রমায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং হালের রাজাকারবিরোধী গণজাগরণ- সবই মাকে রক্ষার আবেগ থেকে উদ্ভূত!

অনেককেই বলতে শোনা যায়, বাঙালির জাগরণকালের সময় পার্থক্য দু'দশক। দুই দশক সময়কাল পরপর তারা জেগে ওঠে তুমুল বিক্রমে, ঘরে তোলে সাফল্য। বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই, দুই হাজার তেরো- জাগরণের বছরওয়ারি কিয়দংশ হিসাব। বায়ান্নতে বাংলাকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন, ঊনসত্তর-একাত্তরে গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর এবার রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, আমরা সফল হবো।

এবার প্রজন্মের দেশ কাঁপানো আন্দোলন শুরু হয়নি কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর হাত ধরে। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে এক প্রবল রাজনৈতিক চেতনা, যা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধকে। প্রচলিত ধারার রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাবিযুক্ত মানুষের দেশপ্রেম, রাজনৈতিক চিন্তা দিয়ে এ আন্দোলন হুট করে রাস্তায় নেমে আসেনি। এর আগে বছরের পর বছর সাইবারবিশ্বে এ নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলছে। অনলাইন, বিশেষ করে ব্লগে এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই লেখালেখি হয়েছে, হয়েছে গবেষণা। এই লেখালেখি-গবেষণা করছে তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু অন্তরে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন, যার বীজ বপন করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার গণআদালতের মাধ্যমে।
কিছুদিন আগেও কিছু মানুষ হতাশ ছিলেন এ প্রজন্ম নিয়ে। গণজাগরণ মঞ্চ এবং রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের আহ্বান সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। কারণ, এ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে; শুধু নির্লোভ একটা ডাকের অপেক্ষায় থেকেছে আজন্ম। যে কিশোর-কিশোরী বই-খাতা আর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, যে গৃহিণী ব্যস্ত ছিলেন দৈনন্দিনতায় কিংবা সংসারধর্মে, যে ধার্মিক ব্যস্ত ছিলেন ধর্মপালনে, যে কৃষক ব্যস্ত ছিলেন লাঙলের ফলা আর চাষাবাদ নিয়ে, যে যুবক আড্ডা কিংবা একান্ত ব্যক্তিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, যে প্রৌঢ় ছিলেন অপরাপর সব নিয়ে- তিনিও নেমেছেন পথে। যিনি শারীরিকভাবে নামতে পারেননি পথে, তিনিও সাহস জুগিয়েছেন পিঠে হাত বুলিয়ে; বলেছেন, এগিয়ে যাও! এটাই আমার বাংলাদেশ, এটাই আমার চেতনা, যা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত!

একাত্তর থেকে দুই হাজার তেরো- মাঝখানে কেটে গেছে বিয়াল্লিশ বছর। অনেক হারিয়েছি, অনেক পেয়েছি। এখন সময় এসেছে তার হিসাব মেলানোর। এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এত দিনে পারিনি বলে এখন পারব না, তা হবে না। এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের পুরোটাই আমার বাংলাদেশ। পতিত মানসিকতার পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ছাড়া সবাই-ই বাংলাদেশের নাগরিক।

আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ নামক গর্ব করার মতো একটা দেশ। আমরা এই প্রজন্ম আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিয়ে আসব রাজাকারমুক্ত একটা পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ। আমি আমার বাবাকে একটা স্বাধীন দেশের জন্য মন খুলে ধন্যবাদ জানাতে পারি, তাই সময়ে সময়ে তার কাছে বিনীত হয়ে বলি 'ধন্যবাদ'। আমি চাই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একইভাবে আমাদের বলুক- ধন্যবাদ, যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের জন্য। তার অন্যথা হলে কিছুদিন পর থেকেই তাদের কাছে মাথা নত করে থাকতে হবে আমাদের! আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা ব্যর্থ হননি, আমরাও ব্যর্থ হবো না- এ আমার প্রবল বিশ্বাস!

 

সমকাল: ১৮ মার্চ ২০১৩। শেষ পাতা "অগ্নিঝরা মার্চ"

Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।